সংঘাতের ভেতর আলোর ঝলকানি by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

একটি রাজনৈতিক দল অন্য একটি রাজনৈতিক দল সম্পর্কে যত সমালোচনা কিংবা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হোক না কেন; তাদের নীতি, আদর্শ, আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে অমিল বেশি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও কৌশলগুলোর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা গেলেও অর্থনীতি,
সমাজনীতি, সামরিকনীতিসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের একই নীতিতে হাঁটার প্রবণতা লক্ষণীয়। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন গতি যেমনটা হওয়ার কথা ছিল, তেমনটা হচ্ছে না। ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন- সব রাজনৈতিক সরকার কালো টাকাকে সাদা করেছে। সবাই দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা মুখে বলেছে; কিন্তু বাস্তবে তা করতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার জনগণের কাছে দেওয়া তার অঙ্গীকারের কথা ভুলে যায় কিংবা কোনো না কোনো কারণে অঙ্গীকার পূরণ করতে পারে না। একে-অপরকে দোষারোপ করার মধ্য দিয়ে পাঁচটি বছর কেটে যায়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। আবার দোষারোপের সংস্কৃতি শুরু।
দ্বন্দ্ব ও সংঘাত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সচরাচর বিদ্যমান। দলগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের পাশাপাশি নিজ দলের ভেতরকার দ্বন্দ্ব কখনো কখনো চরম আকার ধারণ করে। পারস্পরিক স্বার্থ, লোভ-লালসাবেষ্টিত এ ধরনের দ্বন্দ্বের ফলে কাউকে কাউকে মৃত্যুর পরিণতি বরণ করতে হয়। দ্বন্দ্বের ফলে ব্যক্তিগতভাবে যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি রাজনৈতিক দলটিও দারুণভাবে বিপদের সম্মুখীন হয়। কখনো কখনো সারা জীবনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যায়। কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করে, আবার কেউবা রাজনীতি ছেড়ে দেয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্রে আদর্শিক দিকটি যতটা না প্রাধান্য পায়, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও পদবি। এটি বলা অন্যায় হবে না যে মূল দলের ভেতর গণতন্ত্র ও আদর্শ চর্চা করলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনেকটা এড়ানো যেত, দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব হতো, সাধারণ মানুষের সমর্থনও বাড়ত। কিন্তু দলের মধ্যে তোষামোদ ও চাটুকারির প্রবণতা প্রাধান্য পাওয়ায় ভালো ও আদর্শিক মানুষের স্থান দলে কমতে থাকে। ফলে দল হয়ে পড়ে তোষামোদনির্ভর। কিছু মানুষের কাছে দল নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ কারণে দলের ওপর থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু উপায় কী? নির্বাচনের সময় একটি দলকে তো সমর্থন দিতে হবে। শুধু ভালো কিছুর আশায় নির্বাচনে ভোট দেওয়া কিন্তু ক্রমান্বয়ে সে আশার গুড়ে বালিতে পরিণত হয়।
দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে পাওয়া যায় তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন পেশাজীবীগোষ্ঠী, যারা সরাসরি রাজনৈতিক দল নয়; কিন্তু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাদের মধ্যেও রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো এখানেও আদর্শিক লড়াইয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত লোভ-লালসা ও স্বার্থ কাজ করে। তাদের দ্বন্দ্বের প্রতিফলনও আমরা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে লক্ষ করি। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, সিনেট ও শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পক্ষ হেরে যাওয়া নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বেরই ফল। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য দ্বন্দ্ব, যা কিনা শিক্ষকদের প্রভাবিত করে- এমন অবস্থা বিরাজ করছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজেদের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে ক্লাস ও অফিস রুমে তালা দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে শাবিপ্রবিতে। আমরা আর কতটা নিচে নামতে পারি, তার চমৎকার উদাহরণ জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের দ্বারা ঢাকা কোর্টে ভাঙচুর করা। একসময় এই আইনজীবীগোষ্ঠী প্রেসক্লাবের সামনে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মারামারি করেছে। আমাদের কষ্ট হয় তখন, যখন আইনের পোশাক পরে সাধারণ ভাড়া করা রাজনৈতিক কর্মীদের মতো আমাদের দেশের পেশাজীবীগোষ্ঠী ভাঙচুরের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। উপাচার্যদের বিতাড়িত করা খুব কঠিন কাজ নয়। এটি আমাদের দেশে একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু খারাপ লাগে, যখন উপাচার্য বিতাড়িত হওয়ার পর নতুন একজন উপাচার্যকে নিয়োগ দেওয়া হলে তাঁকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। এমন ঘটনাটি ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কখনো কখনো আমরা রাজনৈতিক কর্মীদের মতো আচরণ করি, ভুলে যাই আমরা রাজনৈতিক কর্মী নই; এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের পয়সায় বেতনভোগী পেশাজীবী গোষ্ঠী। শ্রেণীকক্ষ বা অফিস রুমে তালা লাগানো কারো মানায় না। এ কাজটি যখন শিক্ষকরা করেন, তখন সাধারণ মানুষকে আমরা কী জানান দিচ্ছি। নিজেদের বিশেষ ভাবার কোনো সুযোগ রাখছি কি? প্রশ্নগুলোর উত্তর পেশাজীবী গোষ্ঠীকেই দিতে হবে। নইলে একদিন সাধারণ মানুষও তাদের ঘৃণার চোখে দেখবে।
রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী গোষ্ঠী যখন দলাদলি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়, নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত, নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না, আইনের প্রতি যখন শ্রদ্ধাশীল হয় না, তখন আমাদের দেশের নিবেদিতপ্রাণ গরিব কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করেন; কিন্তু ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। তাঁরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁদের কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্যের কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক দল কিংবা পেশাজীবী গোষ্ঠীকে হরতাল বা সমাবেশ আহ্বান করতে দেখা যায় না। অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ নিজেদের ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের কথা না ভেবে সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করছেন, চিকিৎসা সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে, দেশের বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসরে থেকে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র তাঁদের জন্য কী করল বা না করল তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। লক্ষ্য একটিই, নিজ থেকে কিছু একটি করা। এ লক্ষ্যে তাঁরা বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন; কিন্তু তাঁদের জন্য আমরা কী-ই বা করি বা করতে পারি। এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তাঁদের কাজের স্বীকৃতিটুকু মিলছে না। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় তাঁদের জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন ছাপা হয়, কিছু বেসরকারি সংগঠন কিংবা টেলিভিশন চ্যানেল তাঁদের কাজের স্বীকৃতি দেয়- এর মধ্যেই সব কিছু সীমাবদ্ধ। সমাজের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী গোষ্ঠীর তুলনায় তাঁদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। তাঁদের ছোট ছোট কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে আগামী দিনের বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে আমরা বেগবান করতে পারি। আসুন, সবাই আমরা তাঁদের কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করি।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.