পরিবেশ-জঙ্গল তুমি কার? by পাভেল পার্থ

জনদ্রোহের কারণে সবেমাত্র আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সরকার সাফারি পার্কের জন্য কীভাবে স্থানীয় জনগণের ৩৬৩ একর শাইল ধানের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? আমরা কি তাহলে গরিব মানুষের ভূমি অধিগ্রহণ প্রশ্নে সরকারের এ ভূমিকাকে তার রাজনৈতিক দার্শনিক অবস্থান হিসেবে পাঠ করব?


কবীর সুমনের একটি গান আছে, 'জঙ্গল তুমি কার?' সুমন গেয়েছেন, 'জঙ্গল তুমি কার/স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাকি বেনিয়ার ঠিকেদার? জঙ্গল তুমি কার/সরকারি রাইফেল নাকি দলের পাওনাদার? জঙ্গল তুমি কার/বাইরের তাত্তি্বক নাকি জন্মসূত্রে যার? জঙ্গল তুমি কার/শাল-মহুয়ার ছায়া নাকি পুলিশি বলাৎকার? জঙ্গল তুমি কার/মুখ বুঝে সব সওয়ার নাকি বিদ্রোহ এইবার?'
বাংলাদেশের বনজঙ্গল ঘিরে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো নিয়ে বরাবরই জনমনে এ প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসে। কিন্তু রাষ্ট্র সব সময় জন্মসূত্রে জঙ্গলের অধিবাসীদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে প্রায় গায়ের জোরে 'বন রক্ষা'র নামে তথাকথিত উন্নয়নের করাতকল চালায় দেশের ক্ষয়িষ্ণু অরণ্য জীবনের ওপর। বনভূমি রক্ষার জন্য রাষ্ট্র জাতীয় উদ্যান, সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনভূমি, ইকোপার্ক, সাফারি পার্ক কি সামাজিক বনায়নের মতো কত নামে-বেনামে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে গলদঘর্ম থাকে সারাক্ষণ। এ রকম উন্নয়ন মারদাঙ্গায় একটি জঙ্গলও আর নিজের মতো জান ও জবান নিয়ে বিকশিত-বিরাজিত নয় এখন। অরণ্য সংরক্ষণের প্রশ্নে রাষ্ট্রের এ অবিরাম ব্যর্থতার জন্য দায়ী রাষ্ট্রের অরণ্যবিচ্যুত অধিপতি মতাদর্শ ও সংরক্ষণের নামে বন্দুক বাহাদুরি মনস্তত্ত্ব। স্থানীয় বন অধিবাসী খাসিয়া জনগণের জানের দাবিকে পাত্তা না দিয়ে মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ডে ইকোপার্ক স্থাপন করে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ইজারা দেওয়া তাই এ নির্দয় রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব। শালবন উপড়ে ফেলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কথায় আগ্রাসী একাশিয়া লাগাতে এ কারণে বন বিভাগের সমস্যা হয় না। অন্যায়ভাবে মধুপুর শালবনে জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বনবাসী পীরেন স্নালকে হত্যা করেও রাষ্ট্র কোনো অপরাধবোধে ভোগে না। রাষ্ট্র বরাবর অরণ্য দেখে কাঠের বাগান, বাণিজ্যিক কাঁচামালের আড়ত আর শহরের ধনীদের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে। তবে অরণ্যনির্ভর বনবাসী জনগণের কাছে জঙ্গল মানে এক বহমান জীবনধারা। এর কোনো মালিকানা নেই, যাকে টুকরা করে কেটে দোকানের পাল্লা-পাথরে মেপে বিক্রি করা যায় না। দেশের অরণ্য ভূমি নিশ্চিহ্নকরণের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে সরাসরি রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলো, বহুজাতিক বাজার ও প্রভাবশালীদের দখলগিরি দায়ী। কিন্তু রাষ্ট্র কখনোই এসব অন্যায় ও নিপীড়ন প্রশ্ন করে অরণ্য জীবনের মমতায় দাঁড়াতে সাহস করেনি। রাষ্ট্র কেবল ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য ভাগ বসায় অরণ্যনির্ভর জনগণের অরণ্য জীবনের ওপর।
কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের পর গাজীপুরের ভাওয়াল গড়ের রাথুরা শালবনে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক'-এর কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ বন বিভাগ। রাথুরা বিটের ৫ হাজার ৫২৪ দশমিক ১৬ একর বনভূমির ভেতর প্রায় ৪ হাজার একর নিয়ে এক প্রশ্নহীন সাফারি পার্কের কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ। মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের ভূমির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, স্থানীয়ভাবে এখানে উঁচু ভূমি চালা ও নিচু ভূমিকে বাইদ বলে। বাইদ জমিগুলোই বনের আশপাশের জনগণের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম সূত্র। স্থানীয়ভাবে এ কৃষি জমিগুলো শাইল জমি, শাইল ধানের জমি হিসেবে পরিচিত। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজীপুর' শীর্ষক তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের আওতায় সাফারি পার্ক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বড় রাথুরা মৌজার ৩৬৩ দশমিক ১৭ একর শাইল জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৩০০ পরিবারকে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। রাষ্ট্রের জনপ্রতিবেশ বিচ্ছিন্ন এ উন্নয়ন কর্মসূচির বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ প্রতিনিয়ত মজবুত করছে নিম্নবর্গের ঐক্য ও প্রতিবেশদ্রোহ। জনদ্রোহের কারণে সবেমাত্র আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সরকার সাফারি পার্কের জন্য কীভাবে স্থানীয় জনগণের ৩৬৩ একর শাইল ধানের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? আমরা কি তাহলে গরিব মানুষের ভূমি অধিগ্রহণ প্রশ্নে সরকারের এ ভূমিকাকে তার রাজনৈতিক দার্শনিক অবস্থান হিসেবে পাঠ করব? আড়িয়ল বিলের পরপরই সরকারের উচিত ছিল বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ, অধিগ্রহণ ও স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা বিষয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন-রাজনৈতিক ধারাকে সারা দুনিয়ায় জোরালোভাবে তুলে ধরা। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা সরকারের একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। কিন্তু সরকার তার এ অবিস্মরণীয় ও সফল একটি প্রতিবেশীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে চূড়ান্তভাবে উধাও করে আড়িয়ল বিলের পর আবার রাথুরায় সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রশ্নে নির্দয় ও একরোখা হয়ে উঠেছে। রাথুরা শালবনের চারপাশের ভেরামতলী, হাসিখালী, জয়নাতলী, বেতকুড়ি, পিরুজ আলী, ইন্দ্রপুর, বেলতলী গ্রামের অধিবাসীরা রাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না। কেননা আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে, দেশের যাবতীয় উন্নয়নের জন্য গরিব মানুষের জল-জঙ্গল-জুম-জমিন অধিগ্রহণ করারই ক্ষমতা আছে রাষ্ট্রের। ধনী, দখলদার, প্রভাবশালী ও দুর্বৃত্তের কাছ থেকে আইনগতভাবে একটুকরো জমিও উদ্ধার করার কোনো চেষ্টা রাষ্ট্রের নেই বা হয়তো রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতাও তৈরি হয়নি।
যেহেতু প্রস্তাবিত সাফারি পার্ক এলাকায় অনেক মানুষের নিজস্ব রেকর্ডীয় জমি আছে, তাই এসব জমি অধিগ্রহণের জন্য তিনটি ধাপে এ পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এর ২৪ নম্বর ধারায় উলি্লখিত আছে, 'সরকার বন্যপ্রাণী সম্পদ তাহার নিজ আবাসস্থলে (ইন-সিটু) বা আবাসস্থলের বাহিরে অন্যত্র (এক্স-সিটু) সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এবং জনসাধারণের গবেষণা, চিত্তবিনোদন এবং শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যে কোনো সরকারি বনভূমিকে বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সাফারি পার্ক, ইকোপার্ক, বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র বা উদ্ভিদ উদ্যান ঘোষণা করিতে পারিবেন।' রাষ্ট্রের পক্ষে এখন পর্যন্ত কেউ রাথুরা শালবন এলাকার স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সাফারি পার্ক বিষয়ে কোনো আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত করেনি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিশ পাঠানো হয়েছে। অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমিগুলোকে সরকারি নোটিশে 'শাইল' জমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই সরকার কৃষিকে দেশের প্রাণ হিসেবে চিহ্নিত করে আবার সাফারি পার্কের নামে দেশের মানুষের একমাত্র সম্বল কৃষি জমি কেড়ে নিতে পারে না। কৃষি ও জুম জমি, নদী, অরণ্য, পাহাড়, টিলা, বিল, হাওর কোনোভাবেই কোনো উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য অধিকৃত হতে পারে না। কারণ এগুলোর সঙ্গে কেবল দেশের জনগণের উৎপাদন সম্পর্ক অর্থনীতি, খাদ্য সুরক্ষাই নয়, এসব প্রাকৃতিক প্রতিবেশের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে জনজীবনের বহমান এক জটিল অধ্যায়। রাথুরা বনের স্থানীয়রা বনভূমি ও শাইল জমিনের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক তৈরি করেছে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই তা সম্মান ও শ্রদ্ধায় বিবেচনা করে সাফারি পার্ক প্রশ্নটির সুরাহা করতে হবে। তা না হলে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব ও সংঘাত আরও বাড়বে।
ভাওয়াল শালবনে ২২০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫ প্রজাতির উভচর ও ৫ প্রজাতির পাখি টিকে আছে। অন্য এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৪ প্রজাতির লতা, ২৭ প্রজাতির তৃণ, ৩টি পাম, ১০৫ প্রজাতির গুল্ম, ১৯ প্রজাতির ছোট উদ্ভিদ ও ৪৩ প্রজাতির বৃক্ষসহ ২২১ প্রজাতির উদ্ভিদ ভাওয়াল শালবনে রয়েছে। এখনও স্থানীয় অধিবাসীরা বনের ঝরে পড়া ডাল-পাতা কুড়িয়েই পারিবারিক জ্বালানির চাহিদা মেটায়। স্থানীয় বর্মণ আদিবাসী নারীরা এখনও বন থেকে কুড়িয়ে আনেন বনআলু, ভেষজগুল্ম ও বুনোফল। রাথুরা বনের আশপাশের আদিবাসী ও বাঙালি শিশুরা প্রথম জীবনের অরণ্য পাঠ নেয় এখনও এ বনভূমির কোলে। জনবিচ্ছিন্ন সাফারি পার্কের মাধ্যমে স্থানীয়দের সঙ্গে অরণ্য জীবনের এ বহমান আখ্যান ভেঙেচুরে খান খান হবে। রাষ্ট্র যদি বুকের দরদ দিয়ে ভাওয়াল গড়ের এ শেষ তলানির শালবনটুকু বাঁচাতে চায় তবে দুর্বৃত্ত-দখলদার-প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বন দখলদারদের প্রশ্রয় দিয়ে বননির্ভর গরিব মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে সাফারি পার্ক বানালেই বন রক্ষা হবে না। বরং স্থানীয় জনগণের বন দর্শন ও বন ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিয়েই সত্যিকার অর্থে রাথুরা শালবন সব দখল ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা সম্ভব। কারণ বেনিয়া ঠিকাদার, দলের পাওনাদার, মন্ত্রণালয়, তাত্তি্বক বা পুলিশি রাইফেল_ কেউই জীবন আগলে জঙ্গল বাঁচায় না। সাফারি পার্কের জন্য অধিগ্রহণ নোটিশ পেয়ে শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ রাথুরা শালবনের জনগণের মতো জঙ্গল বাঁচিয়ে রাখে জন্মসূত্রে জঙ্গলের মানুষরাই।

পাভেল পার্থ : গবেষক

No comments

Powered by Blogger.