পরিবেশ- সবুজ ভবন, আবাসন by এ জেড এম সাইফুদ্দীন

বিশ্বজুড়ে শোনা যাচ্ছে নতুন এক আন্দোলনের কথা, সবুজ জীবনযাত্রার কথা। অন্যভাবে বলতে গেলে সবুজবান্ধব আবাসনের কথা। একটু গভীরে যেতেই বুঝতে পারলাম আন্দোলনের শুরুটা আসলে শিকড় বিস্তার করতে শুরু করেছিল সেই সত্তরের দশকেই।


প্রথমে ব্যক্তি, তারপর সমষ্টিতে আবদ্ধ থাকলেও, হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ সেই আন্দোলন পৌঁছে গেছে বাংলাদেশেও। পাঠকের মনের প্রশ্নটি এসেছিল আমার মনেও, এই সবুজের দেশে সবুজ আবাসন আবার কী? একাংশে কথাটি সত্য। ‘প্রাকৃতিক আবাসন ব্যবস্থা’ বা ‘ন্যাচারাল বিল্ডিং’-এর ধারণাকে আঁকড়ে ধরেই তো জীবন আর জীবিকা সাজায় ৭০ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশি, যাদের একেকটি কুঁড়েঘরকে একেকটি ন্যাচারাল বিল্ডিং বলে মানতে আমরা বাধ্য। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে আরেকটু গভীরে। মানুষের আবাসস্থল ও কর্মস্থল গড়ে তুলতে যে সারি সারি দালানকোঠা গড়ে উঠছে প্রতিদিন ঢাকা ও অন্যান্য শহর-গ্রামে, তাদের কটি পরিবেশবান্ধব?
পরিবেশবান্ধব আবাসন যা দাবি করে, তার থেকে অনেক দূরে তো বটেই, এমনকি স্থানীয় আইনই বা মানছেন কজন, যাঁরা তৈরি করছেন এসব দালানকোঠা? চেনা-পরিচিতদের মধ্যেই কেউ কেউ নাকি শুনতে পাচ্ছেন কানাঘুষা, শিগগিরই বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও দাবি করতে যাচ্ছে, আমাদের রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সব পণ্য তৈরি করতে হবে সবুজবান্ধব মিল-কারখানায়, অফিস-আদালত পরিচালনা করতে হবে সবুজবান্ধব কক্ষে বসেই! এবার চিন্তিত না হয়ে পারবেন না নিশ্চয়ই! চলুন তা হলে একটু ভালোমতো দেখা যাক বিষয়টি কী। আর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থানই বা কোথায়।
‘গ্রিন বিল্ডিং’ বা সবুজবান্ধব আবাসনের মূল উদ্দেশ্য শুধু আবাসনই না, কর্মস্থলসহ সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেই গড়ে তোলা পরিবেশবান্ধব করে। এর মতে, মানুষের প্রকৃত কল্যাণে আসতে হলে প্রতিটি ভবনকেই মানতে হবে প্রাথমিক তিনটি শর্ত, যার পরীক্ষা নিয়ে রীতিমতো সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে ইউএসজিবিসির (ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিংস কাউন্সিল) মতো বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয় তা হচ্ছে: ১. প্রাকৃতিক শক্তি, পানি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের যথাসম্ভব সীমিত ব্যবহার। ২. ভবনটিতে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তির সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ মনোযোগ প্রদান করা এবং প্রতিটি কর্মীর কাজে সাহায্য করা। ৩. উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহূত প্রতিটি ভবনের বর্জ্যের পরিমাণ, সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে এমন সব কাজকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা।
মনটা একটু খারাপই হলো। হায় রে আমাদের নির্মাণশিল্প, হায় রে আমাদের সবুজ দেশ। প্রতিদিন যা দেখি-শুনি, তাতে আমার জানামতে বাংলাদেশ তো এসবের আশপাশেও নেই। তবে তার পরই মনে পড়ল কোনো এক পত্রিকায় দেখা ছোট এক টুকরো খবরের কথা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখনই ভাবছে পরিবেশবান্ধব-পরবর্তী একটি প্রজন্মের কথা। স্কুলে স্কুলে গিয়ে তারা কথা বলছে শিশুদের সঙ্গে, তাদের শেখাচ্ছে কী করে গড়ে তোলা যায় একটা সবুজবান্ধব দেশ ও মানবসম্পদ। ঢাকায় এ ধরনের একটি ভবন নির্মাণ হচ্ছে জেনে সেখানে গিয়েছিলাম বিষয়টি দেখতে ও বুঝতে।
প্রথমেই চোখে পড়ল এমন কিছু বিশেষত্ব, যা দেখে মনে হবে, কেমন করে যেন আর দশটা নির্মাণাধীন ভবন থেকে কেন আলাদা এই ভবনটি। স্থানীয় আইন অনুযায়ী ৫০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিয়ে তৈরি হচ্ছে ভবনটি। কাজে নিয়োজিত দলটি পরে আছে নিরাপদ পোশাক ও ব্যবহার করছে সর্বোচ্চ মানের সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। সবচেয়ে ভালো লাগল ভেবে যে ভেতরের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সামান্য আভাসও যেন বাইরে নেই। এক টুকরো ইট বা সুরকি পড়ে নেই রাস্তা বা ফুটপাতে। বাড়িতে ফিরে সরাসরি ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হলাম। জানলাম নানা কিছু। এই ভবনটি শুধু লিড সার্টিফাইড একটি ভবনই নয়, বরং বলতে গেলে রীতিমতো অর্জন করতে চলেছে সর্বোচ্চ লিড সার্টিফিকেশন, লিড প্লাটিনাম সার্টিফিকেশন।
কী এই লিড? ১৯৯৮ সালে রবার্ট কে ওয়াটসন প্রথম লিডের (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন) ধারণাটির জন্ম দেন। ইউএসজিবিসির (ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল) পরিবেশ ও মানবসম্পদের প্রতি পাঁচটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র বিবেচনা করে তবেই সার্টিফিকেট প্রদান করে লিড, লিড গ্রিন বিল্ডিং হিসেবে। যেদিকগুলো এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় তা হচ্ছে ভবনটির অবস্থান, নির্মাণসামগ্রী, পরিবেশের প্রতি ভবনটি কতটা যত্নশীল, ভবনটি পানির অপচয় রোধ করছে কি না, ভবনের ভেতরকার পরিবেশ, ডিজাইন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতা।
তবে এখন এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে, সব রেখে সবুজ হওয়া নিয়েই বা এতটা মাতামাতি কেন? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায় চাহিদার তুলনায় আমাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতির কথা। লিড সার্টিফিকেশনপ্রাপ্ত একটি সবুজ ভবন শুধু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়েই নয়, বরং অপারেশন খরচ কমাতে সাহায্য করে ৮-৯ শতাংশ, ভবনের বিল্ডিং ভ্যালু বাড়ায় ৭.৫ শতাংশ, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টের ক্ষেত্রে ভবনটিকে এগিয়ে নেয় ৬.৬ শতাংশ, অকুপেন্সি রেশিও বাড়ায় ৩.৫ শতাংশ এবং রেন্ট রেশিও বাড়িয়ে দেয় ৩ শতাংশ পর্যন্ত।
ভালো লাগল একথা ভেবে, যাক, সবুজ দেশটিতে একটু দেরিতে হলেও লেগেছে তা হলে চলমান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আন্দোলন গ্রিন রেভল্যুশনের ছোঁয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশাবাদী, নিশ্চয়ই নির্মাণশিল্পে নিয়োজিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও হাঁটবে সবুজের পথে। হয়তো বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বা ইতিমধ্যেই কাজ করছে কেউ কেউ।
এবার ফিরে আসা যাক শুরুর প্রসঙ্গটিতে। সারা বিশ্বের সবুজ বিপ্লবের অবস্থাটাই বা কী আর বাংলাদেশের অবস্থানটা ঠিক কোথায়। এককথায় বলতে গেলে, সবুজ বিপ্লব বা আন্দোলন যা-ই বলুন না কেন, প্রতিদিনই আরও বড় ও বিস্তৃত হচ্ছে বিষয়টি। আর সবুজের দেশ বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চলে এসেছে এই আন্দোলনের জোয়ারে, একাত্মতা ঘোষণা করেছে বিষয়টির সঙ্গে। নিশ্চয়ই একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি ইটপাথর-কংক্রিটের ভবন হবে এক একটি সবুজ ভবন।
এ জেড এম সাইফুদ্দীন: একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান নির্বাহী।

No comments

Powered by Blogger.