মানুষখেকো মোড়! by ইসমাইল হোসেন

চার রাস্তার মিলনস্থল। প্রতিদিনই হাজারো যানবাহনের ব্যস্ত চলাচল। একদিকে সিগন্যাল বাতি, অন্যদিকে দুরন্ত গতি। জেবরা ক্রসিং পিষ্ট করে শত মানুষের হুড়োহুড়ি। ট্রাফিক পুলিশও গলদঘর্ম। দিন-রাতের অধিকাংশ জুড়েই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে নগরীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক শাহবাগ মোড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- মার্কেট, পার্ক, হাসপাতাল, জাদুঘর ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ব্যস্ততম এই মোড়ে মাঝে-মধ্যেই দুরন্ত গতির বাহন কেড়ে নেয় মানুষের জীবন। এছাড়া প্রতিদিন ছোটখাট দুর্ঘটনা তো আছেই। আর এসব ঘিরে চলে ব্যাপক ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ।
বিসিএস ক্যাডারের স্বপ্ন পূরণ হলো না তৌহিদের: মঙ্গলবার এই মোড়েই দুরন্ত গতির একটি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্র তৌহিদুজ্জামানের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তৌহিদ।

শাহবাগের বলি শাম্মী: ২০০৫ সালের ২৮ মে শাহবাগ মোড়েই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী শাম্মী আক্তারের। তার বাড়ি পঞ্চগড়ে।

শুরুতেই নিভে যায় চঞ্চলের চঞ্চলতা: গত ২৯ এপ্রিল রাতে শাহবাগ এলাকায় বাসের ধাক্কায় নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর পাস করা আজিজুর রহমান চঞ্চল। শাহবাগ শিশুপার্কের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় যাত্রীবাহী বাস তাকে চাপা দিলে তার মৃত্যু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে আজিজ সুপার মার্কেটে আরশি ফ্যাশন নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন চঞ্চল।

চাকরি হয়নি ফটো সাংবাদিক টিটুর: গত ১১ মে শাহবাগ মোড়ের কাছেই রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে মিরপুরগামী ইউনাইটেড পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় নিহত হন বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক মতবাদের ফটো সাংবাদিক শহীদুজ্জামান টিটু। এ সময় তার বন্ধু সোহেল আহত হন। তারা রিকশায় করে গুলশান থেকে শাহবাগে আসছিলেন। টিটুর বাড়ি বরিশাল নগরীর কালিবাড়ি রোডে। তিনি ঢাকায় একটি পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন।

শাহবাগ কেড়ে নেয় যুগ্মসচিব মাহবুবের প্রাণ: গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর শাহবাগে রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ির ধাক্কায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব এ কে এম মাহবুব আলম গুরুতর আহত হন। ২৬ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

নিহত নারী মৈত্রীর সদস্য: এ বছরের ১ জানুয়ারি শাহবাগ এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ি চাপায় রহিমা বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। ভোরে আনন্দবাজার থেকে পায়ে হেঁটে রমনা পার্কে যাওয়ার পথে রাস্তা পারাপারের সময় দ্রুতগামী একটি গাড়ি তাকে চাপা দিলে নিহত হন রহিমা। রহিমা আমরাও মানুষ নারী মৈত্রীর সদস্য ছিল। তার স্বামী রাসেল রমনা পার্কে চায়ের দোকানি।

অজ্ঞাত পরিচয় নারী নিহত: গত বছরের ১৯ আগস্ট রমনা পার্কের পান্থকুঞ্জ গেটের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় (৩৫) এক নারী নিহত হন।

এছাড়াও রয়েছে কিছু হতাহতের ঘটনা। ২০১১ সালের ২২ মার্চ শাহবাগে দুর্ঘটনায় আহত হন গৃহবধু রীতা ও তার প্রতিবন্ধী ছেলে রাহিম। বৈশাখী টিভিতে প্রতিবন্ধীদের একটি অনুষ্ঠানে তাদের যোগ দেয়ার জন্য রীতা তার প্রতিবন্ধী ছেলে রাহিমকে নিয়ে রাজশাহী থেকে কোচযোগে ঢাকায় আসছিলেন। শাহবাগ মোড়ে পৌঁছা মাত্র দ্রুতগামী একটি বাস তাদের কোচটিকে ধাক্কা দেয়।

ভয়ঙ্কর শাহবাগ
আজিজ সুপার মার্কেট, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় জাদুঘর, হোটেল রূপসী বাংলা, বারডেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় গণগ্রন্থাগার, বারডেম, শাহবাগ থানা, শিশু পার্ক ও রমনা পার্ক সংলগ্ন শাহবাগ মোড়ে সব সময়ই থাকে ব্যস্ততা। চার দিক থেকে দুই লেন হিসেবে আটটি সড়ক এসে মিলেছে এই মোড়ে। এর মধ্যে প্রায়শই দেখা যায় চালকেরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন।

বারডেম হাসপাতাল ও শাহবাগ থানা সংলগ্ন দুটি ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তা পথচারীদের খুব কমই ব্যবহার করতে দেখা যায়। দখলের কারণে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, আজিজ সুপার মার্কেট, জাদুঘর, বারডেম ও শাহবাগ থানা সংলগ্ন ফুটপাত দিয়ে মানুষজন ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না। বাধ্য হয়েই পথচারীরা রাস্তা দিয়ে হাঁটে।

ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও জানান, এ মোড়ের বড় সমস্যা গাড়িগুলো খুবই বেপরোয়া চলাচল করে। সিগন্যাল ছেড়ে দিলেই গাড়িগুলো এমনভাবে চলে কেউ সামনে পড়লে তার যেন কোনো রক্ষা নেই।

এছাড়া মানুষজন গাড়ির জন্য রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়িগুলোও যাত্রী নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। অনেক সময় গাড়িগুলো ফুটপাত ঘেঁষে চলে। আর এভাবে ঘটে দুর্ঘটনা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাদুঘরের সামনে দিয়ে বাটা সিগন্যাল ও বারডেম হয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের দিকে যাওয়ার রাস্তা বিপদজনক। সহজে পারাপারের জন্য গাড়িগুলো এ পথ দুটো দিয়ে মূল সড়কে ওঠে। ফলে অন্য দিক থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। বাটা সিগন্যালের দিকে যাওয়ার পথেই রাজধানী পরিবহনের একটি বাস তৌহিদুজ্জামানকে চাপা দেয়।

শাহবাগ মোড়ে দূর্ঘটনা কমবে কীভাবে
শাহবাগ মোড়ে সিগন্যাল বাতি, চারটি স্পিড ব্রেকার, দুটি ফুট ওভার ব্রিজ এবং চার দিকে ট্রাফিক সদস্য থাকলেও যেন কোনো কাজে আসে না।

করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “সেখানে ফুট ওভার ব্রিজ থাকলেও তা কাছাকাছি না হওয়ায় মানুষ উঠতে চায় না। এছাড়া স্পিড ব্রেকার থাকলেও তা এক্সিট লাইনে আছে। তাই মানুষের সহজে উঠানামার জন্য ব্যয়বহুল হলেও চার কোনাকার (ফুলের মতো) ফুট ওভার ব্রিজ দিতে হবে। যাতে সহজেই মানুষ এক কোনা দিয়ে উঠে অন্য কোনায়ও যেতে পারে। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এবং মগবাজারে এরুপ ব্রিজ আছে।

চীন ও কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে যেখানে পথচারী, গাড়ির সংখ্যা, দূর্ঘটনা ও মোড় নেওয়ার সংখ্যা বেশি, সে সব জায়গায় ফুলের মতো ফুটওভার ব্রিজ আছে বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে স্পিড ব্রেকারগুলো স্টপ লাইনে দিতে হবে, তবে রেড ভায়োলেন্স এড়ানো যাবে।

পাশাপাশি সচেতনতা এবং আইনের মাধ্যমে মানুষকে বাধ্য করতে হবে যাতে ফুট ওভার ব্রিজ ব্যবহার করে।

No comments

Powered by Blogger.