বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৯৬স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তি যোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ মোহাম্মদ শরীফ, বীর প্রতীক সম্মুখযুদ্ধে তাঁর মাথায় গুলি লাগে ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদ শরীফসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন কুমিল্লার বিবিরবাজারে।


তাঁরা ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা এবং স্থানীয় ছাত্র-যুবক সমন্বয়ে গড়া মুক্তিযোদ্ধা। এপ্রিল মাসের শেষে তাঁরা বিবিরবাজারে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট গেরিলা দলের সদস্যরা এখান থেকে গোমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখতেন। তাঁরা অনেক সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুমিল্লা শহরের অবস্থানের ওপর মর্টার হামলাও চালাতেন। এতে পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হতো। এ জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রতিরক্ষা অবস্থানে মে মাসের শুরু থেকে বারবার আক্রমণ চালাতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ৮ মে সন্ধ্যার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৯ বালুচ রেজিমেন্ট তাদের গোলন্দাজ বাহিনী এবং ট্যাংকের সাহায্যে অতর্কিতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। সেনাবাহিনী প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের পূর্ব দিকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণ মোহাম্মদ শরীফসহ মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে নস্যাৎ করে দেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেকে নিহত ও আহত হয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়।
পরদিন ৯ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা দক্ষিণ দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আবার আক্রমণ করে। এ দিনের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ এবং চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ হয়। মোহাম্মদ শরীফসহ মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। তাঁরা তাঁদের এই প্রতিরক্ষা অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। যুদ্ধে শহীদ হন তিনিসহ কয়েকজন। যুদ্ধ চলাবস্থায় মোহাম্মদ শরীফের বুকে ও মাথায় গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় তাঁর জীবন প্রদীপ। সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে ভারতের মাটিতে নিয়ে যান। পরে তাঁকে সেখানেই সমাহিত করা হয়।
এই যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে মেজর খালেদ মোশাররফের (বীর উত্তম, পরে মেজর জেনারেল এবং ১৯৭৫ সালে ক্যু পাল্টা ক্যুর ঘটনায় নিহত) বয়ানে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে এবং পেছন দিক থেকে আমরা ঘেরাও হওয়ার আশঙ্কায় আমাকে বাধ্য হয়ে এই অবস্থান ছাড়তে হয়। এ যুদ্ধে ইপিআরের জওয়ানরা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে মনে পড়ে এক নায়েকের কথা। সে শত্রুদের গুলি করতে করতে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে তাদের নিহতের বিপুলসংখ্যা দেখে একপর্যায়ে “জয়বাংলা” হুংকার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই সময় দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মাথায় গুলি লাগে এবং মারা যায়।
‘যুদ্ধে আমার ছয়জন সেনা মারা যায় এবং ৮-১০ জন আহত হয়। আহতদের পেছনে নিয়ে আসি। কিন্তু তাঁদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারিনি। এ রকম একজন আহত তরুণ ছাত্রের কথা মনে পড়ে, যাঁর পেটে গুলি লেগেছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ অপারেশন করার ব্যবস্থা না থাকায় সে মারা যায়।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ শরীফকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫১।
শহীদ মোহাম্মদ শরীফের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার ছয়আনী টগবা গ্রামে। তাঁরা তিন ভাই ও এক বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার ছোট ও অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম সুলতান আলী, মা ছবুরা বেগম।
শহীদ মোহাম্মদ শরীফের ভাই আনোয়ার হোসেনও ইপিআরে চাকরি করতেন। তিনি বর্তমানে বাস করেন ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের রসুলপুরে (বাড়ি ৩, সড়ক ১)। তিনি জানান তাঁর মা যত দিন বেঁচে ছিলেন পেনশন পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত এককালীন টাকা তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু কোনো ভাতা পান না।
সূত্র: আনোয়ার হোসেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.