তৌহিদকে হারিয়ে কাঁদছে বয়রা গ্রাম by শফিক আদনান

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৌহিদুজ্জামান সবার ছোট। মেধাবী ছাত্র তৌহিদকে নিয়ে তাঁর পরিবারের ছিল অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা। ছাত্রজীবনে তৌহিদ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ফলে তাঁকে ঘিরে বয়রা গ্রামের বাসিন্দাদের ছিল অনেক স্বপ্ন-আশা।


পরিবারের স্বপ্নপূরণ ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তৌহিদ। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (আইআর) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষা নিয়ে একদিন দেশমাতৃকার সেবা করবেন। কিন্তু নিমিশেই যেন সব স্বপ্ন-স্বাদ বিলীন হয়ে গেল। একটি বাসের চাকায় গুঁড়ো হয়ে গেল সব। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে বাসচাপায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয় এ মেধাবী ছাত্রের।
মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগেও মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল তৌহিদের। মাকে বলেছিলেন, সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেই বাড়ি যাবেন। একইসঙ্গে বাবার সঙ্গে কথা হলে দোয়া চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার আগেই তৌহিদকে কফিনবন্দি হয়ে বাড়ি ফিরতে হলো।
তৌহিদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের বয়রা গ্রাম এখন শোকে স্তব্ধ। এ মেধাবী ছাত্রের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ। বাবা-মা, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনসহ কাঁদছে পুরো গ্রাম। এলাকাবাসীর কান্নায় বয়রা গ্রামের আকাশ ভারি হয়ে আছে। গত মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে তৌহিদের লাশ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি বয়রায় পৌঁছে। গতকাল বাদ জোহর নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
গতকাল বুধবার সকালে তৌহিদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাবা নিয়ামতপুর বাজারের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বাচ্চু শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন, কোনো কথাই বলছেন না তিনি। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এলাকাবাসী। ঘরে থেকে ভেসে আসছে মা নাসিমা আক্তারের বিলাপ। বড় বোন তানজিলা আক্তারের বুকফাটা আর্তনাদে উপস্থিত সবার চোখ ভিজে যায়। লাশের পাশে নির্বাক হয়ে বসে থাকেন বড় দুই ভাই রুহুল আমিন রাজন ও ফখরুল আলম সাজন। তাঁরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানান, তাঁরা পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই সবসময় আদরের ছোট ভাইটিকে উৎসাহ দিতেন তাঁরা। মানুষের কাছে বুক ফুলিয়ে বলতেন, তাদের ভাই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাঁকে নিয়ে পুরো পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা কোনো কিছুতেই আর পূরণ হওয়ার নয়।
তৌহিদের মা নাসিমা আক্তার জানান, ঈদের ছুটি কাটিয়ে রবিবার ঢাকা গিয়েছিল তার সন্তান। যাওয়ার সময় সবাইকে সালাম করে দোয়া নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন তৌহিদ। আগস্টের ১১ তারিখ বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। ছুটির পুরোটা সময় মাকে তাঁর স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন তিনি।
তৌহিদের মা আরো বলেন, 'আমি শুধু বলেছি বাবা তোমার স্বপ্নই আমার স্বপ্ন। তবে তুমি যা-ই করো না কেন, শরীরের প্রতি যত্ন নিও। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করবে। ছেলে কবে বাড়ি আসবে উন্মুখ হয়ে দিন গুনতাম। ফোন দিতাম বাবা দু-দিনের জন্য চলে আয়। তোকে ভালোমন্দ কিছু খাইয়ে দিই। আমি তো কোনো পাপ করিনি কিন্তু আমার সোনামাণিককে কেন কেড়ে নিলে আল্লাহ।'
বড় বোন তানজিলা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তাঁর আদরের ভাইটি বেঁচে নেই। এই তো কদিন আগেও নিজের হাতে ভাত খাইয়েছেন ভাইকে। তানজিলা জানান, 'বাড়িতে এলে আমিও ছুটে আসতাম। ঢাকা ফিরে যাওয়ার দিন একসঙ্গে বসে ভাত খেয়েছি। সে বলত, আপা আমি বিসিএসের জন্য এখনই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। চাকরি করে যখন বিদেশ যাব তোমাকে অবশ্যই আমার সঙ্গে যেতে হবে। এসব কথা বলে আহাজারি করছিলেন তানজিলা।'
বাবা আমিনুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, 'সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে মেতে থাকত তৌহিদ। বাড়িতে এলে বা ফোনে কথা হলে আমি তাকে বলতাম বাবা এত পড়াশোনা কর না, একটু ঘুমিও, বিশ্রাম নিও। রাস্তাঘাটে সাবধানে চলাচল করতে সবসময় তাকে ফোনে সাবধান করে দিতাম। কিন্তু যে ভয়টা আমি পেতাম সে ভয়ই সত্য হয়ে গেল আমার জীবনে। আমার একটাই দাবি সরকার যেন রাস্তাঘাট নিরাপদ করার উদ্যোগ নেয়। যেন আমার মতো আর কাউকে সন্তানহারা হতে না হয়। যেন কারো স্বপ্ন-সাধ নষ্ট না হয়ে যায়।' করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নিয়ামতপুর হাইস্কুলে লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তৌহিদ।
মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তৌহিদুল ইসলামের মরদেহ আনা হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি। সঙ্গে আসেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। গতকাল বুধবার বাদ জোহর নিয়ামতপুর হাইস্কুলসংলগ্ন ঈদগাহমাঠে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় এলাকার কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়। পরে ঈদগাহসংলগ্ন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র তৌহিদুজ্জামানের মরদেহ।
এদিকে নিহত তৌহিদুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

No comments

Powered by Blogger.