'পড়তে এসে মরব কেন'-শোকার্ত ক্যাম্পাসে কফিন মিছিল

প্ল্যাকার্ডে লেখা- 'নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে আর কত রক্ত চাই?' বাসের ধাক্কায় সহপাঠী তৌহিদুজ্জামান নিহত হওয়ার ঘটনায় শোকাহত বন্ধুরা গতকাল বুধবার এ রকম অসংখ্য প্ল্যাকার্ড হাতে মৌন মিছিল করেছেন। এ ছাড়া কফিন মিছিল, সমাবেশ, গায়েবানা জানাজা, শাহবাগে অবস্থানসহ চার দফা দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র তৌহিদুজ্জামান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস থেকে বাইরে যাওয়ার পথে শাহবাগ মোড়ে রাজধানী এক্সপ্রেসের একটি বাসের ধাক্কায় নিহত হন। ঘটনার প্রতিবাদে তাঁর সহপাঠী ও অন্য শিক্ষার্থীরা গতকাল বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। অন্যদিকে তৌহিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালক আনোয়ার হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
শোকাহত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল করেন। এ সময় তাঁদের বহন করা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, 'আমরা পড়তে চাই, চাই না মরতে', 'পড়তে এসে মরব কেন?', 'খুনি চালকের ফাঁসি চাই'; 'হাউ ফার সেফটি ইজ!'; 'আজ তৌহিদ, কাল আমি, পরশু আপনি, তারপর...?'; 'বিচার চাইলে গুলি কেন?'; 'হয় তৌহিদকে ফিরিয়ে দিন, নইলে দোষী বাসচালককে ফাঁসি দিন'; 'বিচার করতে না পারলে পদত্যাগ করুন'- ইত্যাদি স্লোগান। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে মৌন মিছিলটি ক্যাম্পাস ঘুরে শাহবাগ মোড়ের দিকে যায়। পরে কলা ভবনের সামনে এসে শেষ হয়।
কাফনের কাপড় পরে মিছিলে অংশ নেওয়া তৌহিদের বন্ধু আফফান আবেগকাতর কণ্ঠে বলেন, 'বড় সহজ-সরল ছিল আমার বন্ধু তৌহিদ। আমরা ওকে নিয়ে অনেক দুষ্টুমি করতাম। কিন্তু ও কখনো রাগ করত না।'
আফফান বলেন, 'বন্ধুকে তো আর ফিরে পাব না। অব্যাহত দুর্ঘটনারোধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমাদের দাবি।'
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'আমরা চাই না এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। আমরা বিচার চাই।' তৌহিদের পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান তিনি। এ সময় অধ্যাপক শহিদুজ্জামান, ড. টি আর আবরারসহ বিভাগের অনন্য শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীরা মধুর ক্যান্টিন থেকে কফিনসহ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এবং চার দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো পড়ে শোনান শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী তৌফিক ইমাম। চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- এক. বাসচালক ও ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং তৌহিদুজ্জামানের পরিবারকে দেখভাল করার সমস্ত দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতে হবে। গুলিবিদ্ধসহ আহত অন্য দুজনের চিকিৎসার ব্যয়ভার প্রশাসনকে নিতে হবে। দুই. শিগগিরই শাহবাগ মোড়ে বহুমুখী আন্ডারপাস নির্মাণের কাজে হাত দিতে হবে এবং ২০ দিনের মধ্যে তা শেষ করতে হবে। তিন. বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে বাস-ট্রাক-মিনিবাস-পুলিশের ট্রাকসহ বহিরাগত যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি প্রশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে সার্বক্ষণিক প্রহরা বসাতে হবে। চার. শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায় স্বীকার করতে হবে এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় শাহবাগ এলাকা দিয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে। শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভাঙচুরের আশঙ্কায় সকাল থেকে ক্যাম্পাসের চারদিকের গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শাহবাগ মোড়ের মাঝখানে শিক্ষার্থীরা নিহত তৌহিদুজ্জামানের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে গায়েবানা জানাজা পড়েন। জানাজা পড়ান শাহবাগ সাদ মসজিদের খতিব ইব্রাহীম খলিল। জানাজা শেষে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে দেড় ঘণ্টা অবস্থান করেন। পরে উপাচার্যের কার্যালয়ের ভেতরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, সারা দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হলেও সরকারের টনক নড়ছে না। তৌহিদের নিহত হওয়ার ঘটনায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তাঁরা।
স্বপ্নের মৃত্যু : একবুক স্বপ্ন নিয়ে তৌহিদুজ্জামান ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বছর শেষ না হতেই বাসের ধাক্কায় এক নিমিষে ফুরিয়ে গেল তাঁর সব স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ২০৮ নম্বর কক্ষে থাকতেন সিট ভাগাভাগি করে। সঙ্গী পিপাস বলেন, 'তৌহিদ মেধাবী ছাত্র ছিল। ছিল বিনয়ী। বেশ লেখাপড়া করত। ওর ইচ্ছে ছিল বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেবে।'
বাসচালকের রিমান্ড মঞ্জুর : আদালত প্রতিবেদক জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদুজ্জামানের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালক আনোয়ার হোসেনের জামিনের আবেদন নাকচ করেন ঢাকা মহানগর হাকিম মো. রেজাউল করিম। গতকাল তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার অপর আসামি বাসচালকের সহকারী রনিকে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার ওসি রুপেশ চন্দ্র বাসচালককে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চান।
তৌহিদুজ্জামানের মৃত্যুর ঘটনায় ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা এস এম কামরুল আহসান শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলায় বাসচালক আনোয়ার এবং সহকারী রনিকে আসামি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.