বিশেষ সাক্ষাৎকার : আ স ম আবদুর রব-তৃতীয় শক্তি ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চার খলিফার একজন, জয় বাংলা বাহিনীর নেতৃত্বে স্বাধীন পতাকা উত্তোলনের চার নেতার অন্যতম রাজনীতিক আ স ম আবদুর রব। সশস্ত্র এই মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।


বর্তমানে জাসদের একাংশের সভাপতি। দেশের রাজনীতি, ভবিষ্যতের সরকারসহ নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে কালের কণ্ঠের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুজ্জামান তুহিন
কালের কণ্ঠ : সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবে না, আর বিরোধী দল তত্ত্বাবধয়াক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না- তাহলে এই বিরোধপূর্ণ মনোভাবের কারণে কি বাংলাদেশে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের মতো সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে?
আ স ম রব : সংবিধান সংশোধনীর যে রায় আদালত থেকে এসেছে, তার কথা বলে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়কে যাবে না। আর বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন করবে না। দেশের মানুষ কী চায়? দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ভোটার অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ একটা ফেয়ারফিল্ড চায়। ভোটের সময় যেন সবখানে সমতা বজায় থাকে। এ দাবিতে আজ সবাই সোচ্চার। অথচ আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলল। বিএনপিসহ বিরোধীদের মতামত আমলেই নিল না। এটা কিন্তু কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমাদের দেশেই নির্বাচন হয়েছে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে তা হয় না। গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমি ব্রিটেনেও কিন্তু ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন হয় না। আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। যে সরকার থাকে তাদের রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া নির্বাচনের আগে তেমন কিছু করার নেই। নীতি নির্ধারণ, পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে তাদের করার কিছু থাকে না।
নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনসংক্রান্ত নীতিমালায় রয়েছে, নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। এক দল থাকবে ক্ষমতায়, আরেক দল থাকবে ক্ষমতার বাইরে। একজনের হাতে থাকবে পুলিশসহ প্রশাসনের সব ক্ষমতা, তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন; অন্যদিকে বিরোধী দল নির্বাচন করবে- এটা হতে পারে না, এটা হয় না। এটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় না। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে দেশে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এ ধরনের পরিস্থিতিতে আবার কি সেনাসমর্থিত সরকার আসতে পারে?
আ স ম রব : সেনাবাহিনী ১৯৭২ সালের পরে যেভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে বা রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েছিল, এখন সে পরিস্থিতি নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোনো সেনাবাহিনীই একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি না হলে এগিয়ে আসে না। এটা হলে হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অযোগ্যতার কারণে। তারা ওয়ান-ইলেভেন থেকে শিক্ষা না নেওয়ায় যদি একটি সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে কী হবে বলা মুশকিল।
ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চাচ্ছে আর বিরোধী রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানাচ্ছে। এটার যদি সমাধান না হয়, তাহলে সাংঘর্ষিক অবস্থায় চলে যাবে। দেশের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতি আন্দাজ করে বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকবে না। সেটা তাদের হাতের বাইরে চলে যাবে।
কালের কণ্ঠ : কেউ কেউ বলছেন, একটা তৃতীয় শক্তি তৈরি হওয়ার মতো বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?
আ স ম রব : তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি বলতে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, এই দুই রাজনৈতিক শক্তির বাইরে অন্য আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি।
তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি যতটা না রাজনীতিকদের মাথা থেকে এসেছে, এর চেয়ে বেশি এসেছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। দেশের শতকরা ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। যারা বিগত ৪০ বছর আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আসছে, তারাও এই সরকারের বিপক্ষে চলে গেছে। গতবার যাদের ভোট এ সরকার পেয়েছে, তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নত বা সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশের জন্য। যে বাংলাদেশ আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে ক্ষমতাসীন সরকার অতীতের চেয়ে খারাপ কাজ করেছে, যা জনগণ সমর্থন করে না। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, ঘুষ, সন্ত্রাস, খুন ব্যাপক হারে বেড়েছে। এমন কোনো অঙ্গন নেই, যেখানে গত সাড়ে তিন বছরে এসব বিষয় কমেছে বরং বেড়েছে আগের তুলনায়।
২৩ দফা দিয়ে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগ এসব দফার একটিও বাস্তবায়ন করেনি। অপচয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নিয়ে সরকার সাড়ে তিন বছর পার করেছে ও করছে। এতে জনগণের যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তা কিন্তু প্রশমিত হয়নি বরং বেড়েছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এ দুই দলই বাংলাদেশের অগ্রগতির পক্ষে বাধা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথে বাধা। বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার পথে বাধা। গুণগত রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বলিষ্ঠ বৈদেশিক নীতিসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের যে জন-আকাঙ্ক্ষা, তাদের সে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আপনি তাহলে বলতে চাইছেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের অভিযোগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের শাসনামল যদি তুলনা করা যায়, তাহলে গুণগতভাবে কোনো পার্থক্য নেই?
আ স ম রব : একদম তাই।
কালের কণ্ঠ : ব্যাখ্যা করুন।
আ স ম রব : পার্থক্য তো নেই-ই বরং বেড়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আরো বেশি করেছে। দেশের এমন কোনো খাত নেই, যেখান থেকে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি হচ্ছে না। এমনকি হতদরিদ্রদের বিধবা ভাতা, কাবিখা, ভিজিডি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা- এসব দলীয় নেতা-কর্মী, মন্ত্রী-এমপির মাধ্যমে অবাধে লুটপাট করা হয়েছে। সরকারের থেকে শুরু করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থেকে শুরু করে কয়েক শ সংগঠন গড়ে উঠেছে সারা বাংলাদেশে। যেখানে সরকারি খাসজমি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে একটি সাইনবোর্ড তুলে দিয়ে এসব দলীয় ক্যাডাররা জমি দখল করেছে। এমন কোনো কাজ নেই- পিয়নের চাকরি থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পর্যন্ত- সর্বত্র চাকরি-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য ও নিয়োগ-বাণিজ্য হচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত দুর্নীতির ব্যাপারে সব থেকে বড় যে জিনিসটা এসেছে তা হলো পদ্মা সেতু। অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিচারের সম্মুখীন করেছে। এই দুই কর্মকর্তা যখন আদালতে দাঁড়িয়ে স্টেটমেন্ট দেবেন তাঁদের কাছ থেকে কারা ঘুষ নিয়েছে, তখন তো থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে। কারা কারা গেছে, তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন কারা জড়িত, তা জানা যাবে। তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ আমাদের সরকার পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চায় কি না। কারণ বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে যদি অর্থ চায়, তাহলে তদন্ত করলে দুর্নীতির যেসব তথ্য রয়েছে, তাতে থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে। সরকার নিজেই চাইছে না বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু হোক।
আমার জানা মতে, বিশ্বব্যাংক সরকারের কাছে চিঠি ও ভিডিও দিয়েছে জড়িতদের ব্যাপারে। সেখানে তারা শর্ত দিয়েছে যে ভবিষ্যতে পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে হলে সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সরিয়ে দিতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার কিন্তু সেটা করেছে।
এসবের পাশাপাশি রয়েছে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কিন্তু মারাত্মক ধস নেমেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ লাখ শ্রমিক রয়েছেন। তাঁদের আর আকামা দেওয়া হচ্ছে না। নতুন করে লোক নেওয়া বন্ধ। মালয়েশিয়ায়ও কর্মী যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ইরাক, সৌদি আরব, দুবাই থেকে যদি এই ৪০ লাখ শ্রমিক দেশে ফেরত আসেন তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, একবার কল্পনা করুন! এ তো গেল শ্রমবাজার। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো তাদের সব সাহায্য বন্ধ করার পথে এগোচ্ছে। জাইকা, এডিবি, বিশ্বব্যাংকের প্রায় ৫০টি প্রকল্প ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ভেতরে ভেতরে কী ঘটছে তা কিন্তু জানা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না, দেশ কত বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
যেমন ধরুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এমপিওভুক্তি যেটা হতো, সেখান থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থ সাহায্য তুলে নিয়েছে। এভাবে সব খাতে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে। এখন সরকার বলতে যা আছে, তা নামকাওয়াস্তের সরকার।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ দুই জোটের কাছে আর কিছু আশা করে না। এ দুই জোট দেশ ও জনগণের অগ্রগতির পথে বাধা। ঘর থেকে বাইরে কোথাও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই। মানুষ এখন এই জোটের কাছ থেকে পরিত্রাণ চায়। এ দুই জোটের কাছ থেকে পরিত্রাণ চাওয়ার অর্থ হলো, জনগণ একটি তৃতীয় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি চাইছে। এটাই তৃতীয় শক্তি। এখন এই তৃতীয় শক্তির আওয়াজ সারা দেশের প্রতিটি ঘরে উঠেছে। মানুষ অপেক্ষা করছে, তাদের কখন ডাক দেওয়া হবে। মানুষ ডাক পেলেই এই অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবে।
কালের কণ্ঠ : আপনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই সরকারের ওপর দাতা সংস্থাগুলোর আস্থা নেই, বিদেশি শ্রমবাজার স্থবির আর জনগণ এ সরকারকে চায় না। তাহলে এই সরকার যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে অনমনীয়, তারা এ শক্তিটা আসলে কোথায় পাচ্ছে?
আ স ম রব : এই সরকার জনগণের জন্য কিছু করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় দুটি জিনিস হয়। হয় নমনীয় হয়, সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। চেষ্টা করে কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার অথবা অর্বাচীন, গোঁয়ারগোবিন্দ, আত্মম্ভরিতা কাজ করে। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। এ কারণে যা খুশি তা-ই আচরণ করছে।
দেখুন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ করল, তখন বিশ্বব্যাংককেই বলা হলো দুর্নীতিবাজ। যদি বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিবাজ হয় তাহলে তার কথা শুনে আবুল হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করালেন কেন? যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের 'কি পোস্টে' থাকা কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে দিলেন কেন? একজন উপদেষ্টাকেও আপনারা সরাতে রাজি, যদি বিশ্বব্যাংক আপনাদের ঋণ দেয়।
এখানে যে বিষয়টি বলা প্রয়োজন তা হলো, মন্ত্রীদের কিছুটা স্বাধীনতা থাকে; কিন্তু উপদেষ্টাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। কারণ মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ের ফাইলপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়, তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু উপদেষ্টা? উপদেষ্টাদের কিন্তু কোথাও স্বাক্ষর করতে হয় না। তাঁরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বাইরে তাঁদের কিছু করার থাকে না। উপদেষ্টাকে যখন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তখন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেখানে চলে আসেন। উপদেষ্টা মসিউর রহমানের পদত্যাগের অর্থ হলো, মসিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কোনো কাজ করেছেন, যেটার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। এ পর্যায় চলে আসার পর বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে, তা হতাশাজনক।
বিশব্যাংককে দুর্নীতিবাজ বলা হচ্ছে; অথচ বিশ্বব্যাংকের বিচার করার ক্ষমতা তো বাংলাদেশ সরকারের নেই। ফলে এ ধরনের মন্তব্য সারা পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকে একটি হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এখন মানুষের মুখ আছে বলেই কি সব কথা বলতে হবে? হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পরই কেবল এসব মানুষ বলতে পারে। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়, ধরাকে সরা জ্ঞান করে। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে বড় নেতা নন।
আর যদি জনগণ আওয়ামী লীগের পেছনে থাকত তাহলে তিনি এসব করে পার পেয়ে যেতেন। বাংলাদেশের মানুষ তো এখন সরকারের পক্ষে নেই। মনে করুন মার্চে যখন বঙ্গবন্ধু বললেন- 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' তখন কিন্তু তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের হয়েই এ সাহস দেখিয়েছিলেন। আজকে সেই সাড়ে সাত কোটি সাড়ে চৌদ্দ কোটি হয়েছে। এখানে শতকরা সাড়ে ১৪ জনও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে নেই, সেখানে কথা বলার সময় একটু মেপে ও হিসাব করে বলা উচিত। এসব কথা শুনে মানুষ হাসছে, সারা পৃথিবী হাসছে। এসব কথা সুস্থ মানুষ বলে না।
যত দিন যাচ্ছে আওয়ামী লীগ দেশে ও বিদেশে একঘরে হয়ে যাচ্ছে। এর পরিণতি কিন্তু ভয়াবহ।
কালের কণ্ঠ : এবার আসি ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে। গ্রামীণ ব্যাংক ড. মুহাম্মদ ইউনূূসকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
আ স ম রব : গ্রামীণ ব্যাংক একটি বেসরকারি ব্যাংক। এই ব্যাংক প্রায় ৯০ লাখ মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছে। এখানে সরকারের কোনো অবদান নেই। মাত্র ৩ শতাংশ শেয়ার নিয়ে সরকার এই ব্যাংকের ওপর যেভাবে মাতব্বরি ফলাচ্ছে, তার ফল শুভ নয়। একবার ভাবুন তো, ৯০ লাখ মানুষ এই ব্যাংকের সঙ্গে জড়িত; জড়িত তাদের পরিবারও। এই পরিবারের মানুষগুলো এ ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। এসব অতিদরিদ্র মানুষের ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়, ঘরে টিনের চাল উঠেছে। তারা দুই বেলা খেতে পারে। এ ধরনের একটি কাজ আমাদের দেশের সরকার যেখানে করতে পারে না, সেখানে একজন ব্যক্তি এ কাজ করেছেন। তাঁকে কোথায় পুরস্কৃত করা হবে, তা না করে উল্টো তাঁকে হেনস্তা করা হচ্ছে। দেখে যা মনে হচ্ছে, এটা ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর সরকারের আক্রোশ।
সরকারের পক্ষে মানুষ নেই। এই গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ও তাদের পরিবারের ভোট হিসাব করলে কমপক্ষে তিন কোটি, শেয়ারবাজারের ৩৫ লাখ মানুষের পরিবারকে ধরলে আরো এক কোটি, সব মিলিয়ে চার কোটি ভোটার তো সরাসরি এই সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ, তা এখনই আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
এর পাশাপাশি যদি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৪০ লাখ শ্রমজীবী মানুষ ফিরে আসে, তাহলে এই সরকারের ভাগ্যে কী আছে একবার চিন্তা করুন! প্রতিদিন পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সাত-আটজন মানুষ খুন হচ্ছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন তালা মেরে বাড়ি যেতে। তালা তো মারবই। কিন্তু র‌্যাব, পুলিশ, সরকারের এত এত গোয়েন্দা আপনারা কেন রাখছেন? সরকারের এসব মন্ত্রী যে ধরনের দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলেন, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সীমান্তে মানুষ মারা যায় আর আমাদের সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, অতীতে মেরেছে, এখনো মারছে, ভবিষ্যতেও মারবে। যদি অবস্থা এই হয়, তাহলে তোমরা ক্ষমতা ছেড়ে দাও। আমাদের সরকার দরকার কী? ২৩ দফার দরকার কী? ভোট দিয়েছি কেন? আপনারা সরকারে রয়েছেন কেন? আপনি যদি রাষ্ট্র চালাতে না-ই পারেন, জনগণের দায়-দায়িত্ব না নিতে পারেন, তাহলে বলে দিন, আপনারা অক্ষম। ছেড়ে দিন। যারা চালাতে পারে তারা ক্ষমতা নেবে।
কালের কণ্ঠ : রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর কি সরকার নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে না?
আ স ম রব : এটা তো বেসরকারি ব্যাংক। ১০০ শতাংশের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ শেয়ার দিয়ে এভাবে পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই। আমেরিকায় ক্ষুদ্রঋণের সম্মেলনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গতবারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা করেছিলেন, ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে কথা বলেছিলেন। তখন হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, নোবেল পুরস্কারটি তিনিই পাবেন। নোবেল পুরস্কার গরিব মানুষের ছেলে ইউনূস কেন পাবেন?
ক্ষুদ্রঋণের এই দর্শনটি, যা দরিদ্র মানুষকে ক্ষমতায়ন করেছে, তা কিন্তু সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর নয়। তা একান্তই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের; যা বাস্তবায়ন করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে।
কিছু অর্বাচীন শান্তি বলতে বোঝেন দুজনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া। বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার, দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন- এ বিষয়গুলো যদি ঘটে, তাহলে কিন্তু সমাজে শান্তি চলে আসে। অর্থাৎ দারিদ্র্য কমলে সমাজে শান্তি বিরাজ করে। আমাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞার অভাব আছে। আমরা সব কিছু গুলিয়ে ফেলি। যেমন মানবাধিকারের বিষয়টি। মাঠে বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার আর আদালতে বলছেন মানবাধিকারের বিচার- দুই ধরনের কথা। যদি বিচার শেষ করতে না পারি তাহলে আগামীবার ক্ষমতায় এসে বিচার শেষ করব। আমরা টোকেন বিচার করব- এসব কথাবার্তা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।
কালের কণ্ঠ : এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে দেশে কি তাহলে তৃতীয় শক্তি আসছে?
আ স ম রব : তৃতীয় শক্তি ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। জনগণই চাইছে। জনগণের এই ঐক্য বা চাওয়াকে মাঠে-ময়দানে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি প্রচেষ্টা দরকার। আমি কিন্তু কোনো আশাবাদ থেকে বলছি না। আমি বাস্তবতা থেকে বলছি। খুব বেশি সময় লাগবে না। যুক্তফ্রন্টের খুব বেশি সময় লাগেনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে খুব বেশি সময় লাগেনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে।
গত সাড়ে তিন বছরে বিষয়গুলো এমনভাবে চলে এসেছে, যা তৃতীয় শক্তি উত্থানের পেছনে কাজ করেছে। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি মাঠে নামলে এ দুই অপশক্তির ভরাডুবি হবে। আমরা বসে নেই। কাজ শুরু করেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ হচ্ছে। আকার-ইঙ্গিতে আপনারা কিছু জিনিস হয়তো লক্ষ করেছেন। কিছু ব্যক্তি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির বিষয়ে কথাবার্তাও বলছেন।
মিসর, সিরিয়া, লিবিয়ার কথা চিন্তা করুন, পাল্টাতে কিন্তু সময় লাগেনি। তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির শুধু দিনক্ষণ দিয়ে আত্মপ্রকাশটা বাকি আছে। জনগণের সামনে শুধু ব্যক্তিগুলোর নাম ও কাঠামো আসতে বাকি রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : তাহলে কি তৃতীয় শক্তি চলতি সরকারের মেয়াদের মধ্যেই দেখতে পাবে জনগণ?
আ স ম রব : এই সরকারের আমলেই হবে এবং শিগগিরই।
কালের কণ্ঠ : কিন্তু নির্বাচনী বিধিমালা যেভাবে শেষবার সংশোধন করা হলো, তাতে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচন করার সুযোগ নেই। তাহলে তৃতীয় শক্তি কিভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে? নাকি নির্বাচনবহির্ভূত পন্থায় ক্ষমতার কথা ভাবছেন?
আ স ম রব : ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে আলোচনা করেছিলেন, সেই আলোচনার একটি বিষয় ছিল যে পৃথিবীর মানুষকে দেখানো, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন চাই। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তা হয়নি। সংবিধান বলুন, আইন বলুন- সবই মানুষের জন্য। জনগণ যখন চাইবে, তখন সব কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব। এ সংসদে তো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। ১৫তম সংশোধনী যেমন হয়েছে ১৬তম সংশোধনীও সরকার করতে পারে।
কালের কণ্ঠ : সংবিধান সংশোধন করে কী ধরনের সরকার হবে?
আ স ম রব : এখানে দুটি কক্ষ হতে পারে। একটি নিম্নকক্ষ অন্যটি উচ্চকক্ষ। একজন মানুষ দুটি ভোট দিতে পারবে এ দুই কক্ষকে নির্বাচিত করার জন্য। উচ্চকক্ষে কোনো রাজনীতিবিদ যাবেন না। সেখানে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কৃষক, শ্রমিকের প্রতিনিধি থাকবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো লোকেরা যাবেন, ড. কামাল হোসেনের মতো লোকেরা যাবেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো লোকেরা যাবেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক থাকবেন, থাকবেন ড. জাফরউল্লাহ, সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। এ ধরনের যেসব মানুষকে সাধারণ জনগণ শ্রদ্ধার চোখে দেখে, যাঁদের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা নেই, অভিযোগ নেই তাঁরা দেশ পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। সেখানে সেনাবাহিনীর লোকও থাকবেন। তাঁরা নির্বাচন করবেন। তবে তাঁরা কেউ নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। সংবিধান সংশোধন করে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ বানিয়ে উচ্চকক্ষের হাতে থাকবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা।
কালের কণ্ঠ : ভবিষ্যতে কি রাজনীতিতে কোনো আশাবাদের খবর আছে?
আ স ম রব : আমি রাজনীতিবিদ। শুধু হতাশাবাদের কথা বলতে চাই না। আমি তরুণ সমাজকে বলব, সামনে শুভ দিন আসছে। মাঠে নামতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
আ স ম রব : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.