বাসযোগ্য শহর- ঢাকার দুর্নাম ঘোচেনি, বেড়েছে by এ কে এম জাকারিয়া

গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি লেখা লিখেছিলাম। শিরোনামটি ছিল, ‘ঢাকার এই দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্ব কার?’ (প্রথম আলো, ১৬.০৯.২০১১)। এ লেখাটি ছিল সে সময়ে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক জরিপের প্রতিক্রিয়া। সেই জরিপে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী শহর হিসেবে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।


তখন সবচেয়ে খারাপ শহরের ‘মর্যাদা’ পেয়েছিল জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) নিয়মিতই এই কাজটি করে। বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে উপযোগী শহরগুলোর ধারাবাহিক তালিকা করতে গিয়ে পর্যায়ক্রমে নিচের দিকে নামে তারা। এই তালিকায় সবচেয়ে নিচের দিকে থাকে যে শহরগুলো, সেগুলো বসবাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ হিসেবে বিবেচিত। তখন ১৪০টি শহরের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে সর্বশেষ অর্থাৎ ১৪০তম শহরটি ছিল জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। ঢাকার স্থান ১৩৯তম। তখন অনেকটা পরিহাস করেই লিখেছিলাম, ‘বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী শহরের খেতাব পাওয়া থেকে অল্পের জন্য বঞ্চিত(?) হলাম আমরা!’ এই পরিহাস যে এমনভাবে কাজে লেগে যাবে কে জানত! এবার ২০১২ সালের প্রতিবেদনে ঢাকা যে এই ‘খেতাব’ অর্জন করে ফেলেছে, সে খবর এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকা এখন বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত শহর। দুর্নীতিতে এক নম্বর অবস্থান থেকে আমাদের ‘পতন’ ঘটেছে, ঢাকা এখন আবার আমাদের ভিন্ন এক ক্ষেত্রে এক নম্বর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে!
বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। এবারের জরিপে মেলবোর্ন পেয়েছে ৯৭.৫ নম্বর, আর ঢাকা পেয়েছে ৩৮.৭। জনসংখ্যা ও আয়তন—এই দুটি দিকেও শহর দুটির অবস্থান তুলনা করা যাক। ৩৪০০ বর্গমাইলের মেলবোর্নে জনসংখ্যা ৪০ লাখের ওপর। আর ১৪০ বর্গমাইলের ঢাকায় বাস করে প্রায় দেড় কোটি লোক। কেন দুটি শহর দুদিক থেকে শীর্ষে, তা অনুমান করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। জনসংখ্যা ও জনঘনত্বই কি এই আকাশ আর পাতালের তফাতের জন্য দায়ী? অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি বড় শহরের মধ্যে চারটিই বসবাসের সবচেয়ে উপযোগী ১০টি শহরের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ইআইইউ জরিপ ইউনিটের সম্পাদক জন কেপস্টেক অবশ্য জনসংখ্যা ও জনঘনত্বের বিষয়টিকেই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচনা বলে মানতে রাজি নন, ‘কম জনসংখ্যার প্রাকৃতিক সুবিধার কারণেই যে অস্ট্রেলিয়ার শহরগুলো ভালো করেছে তা নয়, তারা অবকাঠামোর ক্ষেত্রে কিছু বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নতির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।’ ২০১১ সাল থেকেই মেলবোর্ন বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহরের অবস্থান ধরে রেখেছে। মেলবোর্নের সঙ্গে ঢাকার তুলনা নয়, কিন্তু এর মাঝখানে বিশ্বের আরও ১৩৮টি শহর রয়েছে, যেগুলোর সবগুলোই আমাদের প্রিয় ঢাকার চেয়ে বেশি বাসযোগ্য।
ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এই তালিকা তৈরিতে পাঁচটি ক্ষেত্রের প্রায় ৩০টি দিক বিবেচনায় নেয়। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো—এগুলো হচ্ছে বিবেচনার মূল বিষয়। স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় ছোট ও বড় অপরাধ-পরিস্থিতি, সহিংস অপরাধের মাত্রা, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক যুদ্ধের হুমকি, গৃহযুদ্ধের হুমকি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেখা হয় ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সক্ষমতা, সরকারি-বেসরকারি সক্ষমতা ও স্বাস্থ্যসেবার সাধারণ মান। সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত বিবেচনার মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কোন পর্যায়ের, ভ্রমণকারীদের জন্য আবহাওয়াটা কতটুকু আরামদায়ক, দুর্নীতির মাত্রা, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সেনসরশিপের মাত্রা, ক্রীড়াক্ষেত্রে অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি, খাদ্য-পানীয়-ভোগ্যপণ্যের মান ও সেবা-পরিস্থিতি। শিক্ষার মধ্যে বিবেচনায় নেওয়া হয় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার সক্ষমতা, সার্বিক শিক্ষার মান। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে সড়ক যোগাযোগের মান, গণপরিবহন-ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, মানসম্মত বাসা ভাড়া পাওয়ার নিশ্চয়তা, জ্বালানি-পরিস্থিতি, পানি সরবরাহের মান ও টেলিযোগাযোগের মান।
ইআইইউ প্রতি ছয় মাসে এই তালিকা হালনাগাদ করে থাকে। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর বাণিজ্যিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই কাজটি করা হয়। সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কোন কর্মীকে কোন শহরে পাঠালে কী পরিমাণ ‘হার্ডশিপ ভাতা’ (কষ্টকর ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করার ভাতা) দেবে, তা নির্ধারণ করে থাকে এর ওপর ভিত্তি করে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মানবসম্পদ বিভাগ এই তালিকা কাজে লাগিয়ে কর্মীর হার্ডশিপ ভাতা নির্ধারণ করে। সর্বশেষ এই তালিকার পর পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান যদি তাদের কোনো কর্মীকে ঢাকায় নিয়োগ দিতে চায় তবে তাকে নির্ধারিত বেতনের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ‘হার্ডশিপ ভাতা’ দিতে হবে।
যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম বিবেচনা হচ্ছে স্থিতিশীলতা। গত বছর ঢাকা যখন বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত শহর হিসেবে দ্বিতীয় হয়েছিল তখন লিখেছিলাম, ‘স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা ভালোই বলতে হবে। সমস্যাটি তা হলে বাকিগুলোতে। আমাদের দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে না, তার পরও যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত, ঢাকায় কোনো সামরিক যুদ্ধের হুমকি নেই, কিন্তু ৩০ মিনিটের পথ যেতে তিন ঘণ্টার বেশি লাগতে পারে, কার্যকর গণপরিবহন বলতে যা বোঝায়, তা ঢাকায় নেই। আপনি বাসে উঠতে পারবেন না, আবার বেশি পয়সা খরচ করে যে সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পেলেও মিটারে যাবে না। চাইলে ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া যায় না—ঢাকা ছাড়া এমন কোনো রাজধানী শহর আছে বলে মনে হয় না। ঢাকা এমন একটি শহর, যেখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য সামান্যতম যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত, তা-ও নেই। এখানে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক বা গোষ্ঠীগত সহিংসতায় তিন দিনে ৩৯ জনের মৃত্যুর রেকর্ড নেই, কিন্তু এখানে আছে পদে পদে দুর্নীতি। এখানে করাচির মতো সন্ত্রাসের হুমকি নেই, কিন্তু বিদ্যুৎ পাবেন এমন নিশ্চয়তা নেই—এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে শহর অচল হয়ে পড়বে। বড় ধরনের ‘সহিংস অপরাধের উপস্থিতি, সন্ত্রাসের হুমকি, সামরিক যুদ্ধের হুমকি ও গৃহযুদ্ধের হুমকি’ ছাড়াও আমাদের ঢাকা কেন পিছিয়ে পড়ল, তা আমরা অনুমান করতে পারছি। এই যে পরিস্থিতির কথা বছর খানেক আগে লিখেছিলাম তার কি কোনো উন্নতি হয়েছে? তখন ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়, এখন হয়েছে প্রথম। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ১১৭তম থেকে ১৩০তম স্থানে কেন নেমে গেছে, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। সেখানে গৃহযুদ্ধে প্রতিদিনই মারা পড়ছে লোকজন। কিন্তু ঢাকা নিচে নামল কেন? আমাদের অবস্থা কি আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে? নাকি সে সময়ে সবচেয়ে নিচে থাকা জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে নিজেদের পরিস্থিতিকে উন্নত করে এগিয়ে গেছে?
ঢাকা কেন এবার সবশেষে স্থান পেল? ইআইইউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো খাতে ঢাকা সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে। ঢাকার এই কলঙ্ক দূর করতে এই দুটি খাতের প্রতি বাড়তি নজর জরুরি। কিন্তু তেমন কোনো আশা কি আমরা করতে পারি? সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান উন্নয়নে কি চোখে পড়ার মতো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে? ঢাকার যোগাযোগ, ট্রাফিক-ব্যবস্থার উন্নয়ন ও গণপরিবহনের দিকে কি সরকারের একটু মনোযোগ পড়বে? শুধু বিমানবাহিনীর অযৌক্তিক (সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা অন্তত তা-ই মনে করেন) আপত্তির কারণে মেট্রোরেলের মতো কার্যকর গণপরিবহন-ব্যবস্থা কত দিন ঝুলে থাকবে? ব্যক্তিগত যানকে উৎসাহিত করে এমন প্রকল্পের (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) ব্যাপারে সরকারের উৎসাহ কমে কবে বাসনির্ভর ট্রানজিট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার মনোযোগী হবে? আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ঢাকা দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখে এ বছর প্রথম হলো। গত বছর হতাশা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম, ঢাকার এই দুর্নাম ঘোচানোর দায়িত্ব আসলে কার? বোঝা যায় আমাদের দেশে কর্তৃপক্ষ বলে কিছু থাকলেও তাদের টনক বলে কিছু নেই। থাকলে সেটা নড়েচড়ে উঠত। ঢাকাকে বাসযোগ্য করার ন্যূনতম চেষ্টাও হতো। দুর্নাম না ঘোচাতে পারলেও অন্তত বাড়ত না। আর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, এসবও কেউ বিবেচনায় নেন বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছে ঢাকা নিয়ে অরণ্যেই আবার এক দফা রোদন হলো।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.