মানুষ মারার কারখানায় বাতাসে ওড়ে 'মৃত্যুগুঁড়া' by তৌফিক মারুফ

দুজন শ্রমিক ট্রাকের ওপর থেকে একেকটি বস্তা টেনে তুলে দিচ্ছেন আরেক শ্রমিকের মাথায়। ওই শ্রমিক সেই বস্তা নিয়ে ফেলছেন আরেক ট্রাকের ওপর। বস্তাগুলো তোলা ও ফেলার এই পর্যায়ে নাড়া খেয়ে ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে আসছে সাদা পাউডার। এতে সাদা হচ্ছে শ্রমিকদের মাথা, মুখমণ্ডলসহ গোটা শরীর।


সাদা পাউডার উড়ছে শূন্যে, মিশে যাচ্ছে বাতাসে, ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। কড়া রোদের মধ্যেই ঘন কুয়াশার রূপ নেয় চারদিক। একটু পরপরই শ্রমিকদের একেকজন হাঁচি দিচ্ছেন, কেউ দিচ্ছেন কাশি। বুড়িমারী স্থলবন্দরে ভারত ও ভুটান থেকে আমদানি হওয়া বিভিন্ন ধরনের পাথরগুঁড়া লোড-আনলোডের দৃশ্য এমনটাই। এ দৃশ্য শুক্রবার বাদে প্রতিদিনকার। এই পাথরগুঁড়া রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। এগুলো মোজাইক, টাইলস, সিরামিক সামগ্রী, কসমেটিকস, পোলট্রি ফিডের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বাইরে থেকে এ ধরনের পাথর বা পাথরগুঁড়া আমদানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় বুড়িমারী স্থলবন্দর। বিশেষ করে ভারত ও ভুটান থেকেই এ দেশে বেশি পাথরগুঁড়া এসে থাকে। আর এ বন্দরে যত সংখ্যক শ্রমিক কাজ করেন, এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি শ্রমিক সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এ উপাদান নিয়ে কাজ করছেন।
শ্রমিক সর্দার বাদশা মিয়া বলেন, 'এই পাউডারগুলা আমাদের মেরে ফেলছে। কিন্তু কী করব, পেট তো বাঁচাতে হবে। পাউডারগুলা নাকে-মুখে গিয়া শ্রমিকদের মেরে ফেলছে। গামছা দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখলেও কাজ হয় না। ফাঁকা দিয়ে ঢুকে পড়ে। আশপাশের কারখানাগুলোতে অবস্থা আরো খারাপ।'
বুড়িমারী শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি সফর উদ্দিন জানান, বুড়িমারী বন্দর দিয়ে প্রতিদিন এক হাজার টনের বেশি পাথরগুঁড়া এপারে আসে। এগুলো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আনলোড-লোড হয়। এ কাজে ৫০০-রও বেশি শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়া স্থানীয় পাথর কারখানায় পাথর গুঁড়াকরণ কাজ করেন আরো প্রায় আড়াই শ জনের মতো, যাঁদের সবাই কমবেশি এই পাথরগুঁড়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে মরণব্যাধি সিলিকোসিস আর যক্ষ্মা সবচেয়ে বেশি।
এ প্রবীণ শ্রমিক নেতা বলেন, 'এমন ক্ষতিকর কাজে আমরা নিয়োজিত থাকলেও আমাদের স্বাস্থ্য বা জীবনের নিরাপত্তার জন্য মালিক বা সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কারখানায় যখন মেশিনে পাথর ভাঙা হয়, তখন ভেতরে একজনের চেহারা আরেকজনে দেখতে পান না বাতাসে ঘন হয়ে উড়তে থাকা পাথরগুঁড়ার কারণে। এর পরিণতিতে এখানে এক বছর ধরে এক রকম মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে।'
লালমনিরহাট জেলার সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল বলেন, 'আমরা এখানে মানুষ মারার কারখানার মধ্যে আছি। আমরা এলাকার উন্নয়ন-উন্নতি চাই, কিন্তু আমার এলাকার মানুষ মারা যাচ্ছে এমন কারখানা চাই না। কারখানাগুলোকে এমনভাবে চালাতে হবে, যাতে কোনো শ্রমিক বা এলাকাবাসীর কোনো ক্ষতি না হয়। এখন পর্যন্ত এখানকার কোনো কারখানায় এমন কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই।'
উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, কেবল কারখানার ভেতরেই নয়, বন্দরে প্রতিদিন দেশের বাইরে থেকে যে বিপুল পরিমাণ পাথরগুঁড়া আসছে, সেগুলো লোড-আনলোডের ক্ষেত্রে কোনো রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। শ্রমিকরা সবাই এখন মৃত্যুঝুঁকির মুখে। এমনকি আমদানি করা পাথরগুঁড়া লোড-আনলোডের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সিলিকোসিস পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। কেবল কারখানাভিত্তিক শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
ঢাকা বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ খন্দকার হাফিজুর রহমান বলেন, যেকোনো ধরনের পাথরগুঁড়া ফুসফুসে প্রবেশ করে সিলিকোসিস ও যক্ষ্মা হয়ে থাকে। এ রোগ তাৎক্ষণিক না হয়ে চার থেকে ১০ বছর পরেও হতে পারে।
সিলিকোসিস বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলে রাব্বী বলেন, পাথরের কণা অর্থাৎ সিলিকার ক্রিস্টাল ফর্মে (সিলিকন ডাই-অঙ্াইড) বাতাসে সহজেই ভাসতে পারে। তাই অনেক সময় চোখে দেখা না গেলেও এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে এর কোষগুলোকে অকার্যকর করে দেয়। এখন পর্যন্ত এমন কোনো চিকিৎসা নেই, যা দিয়ে এ রোগ ভালো করা যায়। তবে উন্নত দেশের কোথাও কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যা খুবই ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
বুড়িমারী বন্দরের পাশের শ্রীরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল করীম প্রধান বলেন, ১০-১২ বছর ধরে এসব এলাকায় পাথরগুঁড়া করার কারখানা শুরু হয়। সঙ্গে মানুষের মৃত্যুও শুরু হয়। কিন্তু প্রশাসন এদিকে কোনো নজর দেয়নি।
আইনবিধি থাকা সত্ত্বেও সরকারের শ্রম বিভাগ এত দিন বুড়িমারী এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি- এ প্রশ্নের মুখে শ্রম অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মাহফুজুর রহমান ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে এসব কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে এমন মরণব্যাধির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কেউ আমাদের কিছু জানায়ওনি। এ ছাড়া আমি মাত্র গত এপ্রিল মাসে এ অঞ্চলের দায়িত্বে এসেছি। এর পরপরই সিলিকোসিসের খবর পেয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করি।' তিনি আইনের ধারা উদ্ধৃত করে বলেন, 'আমার ক্ষমতা আছে, কোনো কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে আমি তা বন্ধ করে দিতে পারি।' তিনি জানান, সিলিকোসিস শনাক্ত করার আগে এখানে এ রোগে আক্রান্তদের হয়তো কেবল যক্ষ্মার চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এতে কারো কারো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে।
পাটগ্রামের স্থানীয় বেসরকারি চিকিৎসক (এমবিবিএস) গোলাম ফারুক বলেন, 'প্রথম দিকে অনেকেই মানতে চায়নি যে এসব শ্রমিকের সিলিকোসিস হয়েছে। ফলে তাদের কোনো কোনো চিকিৎসক কেবল যক্ষ্মা রোগের ওষুধ দিয়েছেন।'
বক্ষব্যাধির ডা. খন্দকার হাফিজুর রহমান বলেন, সিলিকোসিসে আক্রান্তদের প্রাথমিক লক্ষণ দেখে অনেকে হয়তো কেবল যক্ষ্মার চিকিৎসা দিয়ে থাকতে পারেন, সে ক্ষেত্রে খুব একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নাও হতে পারে।
পাটগ্রামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হায়াত মো. রহমাতুল্লাহ বলেন, এলাকার মানুষকে রক্ষার জন্য কারখানাগুলো ও বন্দরের কার্যক্রমের জন্য নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ জন্য স্থানীয় সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে।
সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিক আব্দুস সালাম বলেন, 'আমি এখন কোনো কাজ করতে পারি না, কিভাবে সংসার চলবে আর কিভাবে চিকিৎসা চলবে বলতে পারি না।' উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল বলেন, অসুস্থ শ্রমিকদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা দরকার। একই সঙ্গে চিকিৎসার জন্য যাতে তাঁদের এলাকার বাইরে যেতে না হয়, স্থানীয়ভাবে তেমন চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।
বুড়িমারী এলাকায় কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে সিলিকোসিসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর এ নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হলে কারখানার মালিকরা বেশির ভাগ সময় গা ঢাকা দিয়ে থাকছেন বলে জানান শ্রমিকরা। দুই দিন ধরে পাটগ্রাম-বুড়িমারী এলাকায় অবস্থানকারী বিশেষজ্ঞ দল কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দু-একজন ছাড়া বাকিদের খোঁজ পায়নি। দলের বিশেষজ্ঞরা জানান, এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই শ জনকে পরীক্ষার আওতায় এনে ৮০ জনকে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি হিসাবে ১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হলেও বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৩০ ছাড়িয়ে গেছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। সিলিকোসিসে আক্রান্তদের বিষয়ে গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জন্য গত জুন থেকে বিলস নামের একটি বেসরকারি সংস্থা পাটগ্রাম উপজেলায় কাজ শুরু করেছে।

No comments

Powered by Blogger.