সাক্ষাতকার ॥ এ বাড়ি শুধু আমাদের নয়, বাংলার জনগণের স্মৃতিবিজড়িত- আমরা দু-বোন মানুষের দোয়া চাই। আর আমরা মনে করি যে বাংলার জনগণই আমাদের সব। তাদের কাছে আমাদের শুধু দোয়া চাওয়া আর তাদের জন্য যদি কিছু করে যেতে পারি এটাই আমাদের সার্থকতা

(পূর্ব প্রকাশের পর) শেখ হাসিনা : মাঝে মাঝে এটা আমার মনে হয় বা এধরনের সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হয় যেমন আমরা হত্যার বিচার দাবি করেছি। অনেকেই প্রচার করে যে রাজনীতি করেন শুধু পিতৃহত্যার বিচার করার জন্য।


পাশাপাশি তারা যখন কোন হত্যা করে তার বিচার চায়, তখনি আমার কাছে এ প্রশ্নটা আসে, মনে জাগে যে একটা হত্যা হলে এত হৈচৈ, বিচার চায় সবাই, এত মানবাধিকারের কথা বলে, আর যারা এ রকম ঘৃণ্য অপরাধী তারা কী শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধান, একজন জাতির পিতা যিনি দেশের স্বাধীনতা এনে দিলেন তাকেই হত্যা করেনি, তারা নারী হত্যাকারী, শিশু হত্যাকারী মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেকের আছে সে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে সদম্ভে সেটাকে প্রচার করা, সদম্ভে সেটা বলে বেড়ানো যে, হ্যাঁ তারাই হত্যা করেছে। এই যে তারা সদম্ভে বলে বেড়াত আর তাদেরই বিভিন্ন দূতবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হলো। আজকে যখন তাদের বিচার হচ্ছে সেই বিচারের সময় আমরা যখন দেখি যে তাদের বাঁচাবার জন্য, তাদের রক্ষা করার জন্য কোন কোন মহল চেষ্টা করছে, এমনকি যেমন একটি রাজনৈতিক দলের একজন এমপি তাদের আইনজীবী হয়ে খুনীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। এটা আমি মনে করি, মানবতার প্রতি চরম অবহেলা, চরম অবমাননা করা। এরা কিভাবে খুনীদের রক্ষা করার জন্য দাঁড়াতে পারে! কিভাবে খুনীদের রক্ষা করতে চায়! যদি সবাই চায় যে এদেশে হত্যা খুন বন্ধ হোক তাহলে তো এই হত্যার বিচার সবার আগে হতে হবে। কারণ একটা হত্যার বিচার না হলে হত্যাকারী যদি শাস্তি না পায়, হত্যাকারী যদি পুরস্কৃত হয়, হত্যাকারী যদি সদর্পে ঘুরে বেড়াতে পারে, যদি রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারে, তারা যদি একটা দেশের দূত হিসেবে পরিচিত হতে পারে তাহলে তো এদেশে খুন বা হত্যা প্রতিনিয়ত ঘটতেই থাকবে। কে বন্ধ করতে পারবে এদেশের খুন হত্যা? কেউ বন্ধ করতে পারবে না। আমার মনে আছে, একটা ঘটনা বলি, আমরা যখন বিদেশে, আমরা যখন আসতে পারিনি কেউ চিনত না আমাদের যে আমরা কারা? কিন্তু যেই শুনেছে যে আমরা বাংলাদেশের, সবাই বললেন, ইস আপনারা কী করলেন? আপনারা বাংলাদেশের মানুষ এমন! এমন একটা মানুষকে আপনারা খুন করে ফেললেন! আমি আর রেহানা মানে আমাদের তখনকার অবস্থাটা, আমাদের চোখে পানি অথচ বলতে পারছি না, বলতে পারিনি, কী বলব। এই যে তাদের চোখে যে একটা ঘৃণা তাদের চোখে যে আমাদের দেশের মানুষের প্রতি যে এ রকম একটা মনোভাব। তার পর বলছে যে এই রকম একটা মানুষকে আপনারা খুন করে ফেললেন, আপনারা কী মানুষ? সত্যিই তখন আমরা কিছুই বলতে পারছি না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কারণ আমাদের দু’জনের চোখে তখন পানি এসে গেছে। এটা দেশের জন্য, জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। যে খুনীরা এতদিন বলে বেড়াতে পেরেছে, তারা মুক্ত মনে ঘুরে বেড়িয়েছে, এতবড় হত্যাকা- করার পরেও তারা মদদ পেয়েছে, এটা সত্যিই একটা জাতি হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত গ্লানির আজকে তাদের বিচারের রায় বেরিয়েছে। আজকে তাদের বিচার কাজ চলছে, আমার তো আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস যে ইন্শাল্লাহ বিচারের রায় একদিন বাংলার মাটিতে কার্যকর হবে এবং বাংলাদেশ এক দিন অভিশাপমুক্ত হবে।
তারানা হালিম : আমরা পৃথিবীতে দেখেছি যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধান এই অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখলের কারণে রক্তপাতময় অভ্যুত্থান কখনও কখনও বলতে পারি নৃশংসতার শিকার হয়েছে। আপনারা এই মহলের চক্রান্তে সম্পূর্ণ পরিবার হারানোর বেদনার ভার বহন করছেন, এই যে স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে আপনারা স্বজন হারিয়েছেন এবং পৃথিবীব্যাপী এধরনের ঘটনা অতীতে ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে এসব বন্ধের জন্য জনমত সৃষ্টির কোন পরিকল্পনা কী আছে আপনার?
শেখ হাসিনা : আমি কিন্তু আমার রাজনীতি শুরু করেছিলাম ওই জায়গা থেকেই। কারণ ১৯৮০ সালে আমি যখন লন্ডনে যাই তখন নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত শন ম্যাকব্রাইড আয়ারল্যান্ডের যিনি নেতা, তিনি টমাস উইলিয়ামসহ আরও অনেক ব্রিটিশ এমপিকে নিয়ে আমরা একটা ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করি। সেটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বা তদন্তের জন্য। যদিও সে কমিশনকে তখন জেনারেল জিয়া ছিলেন রাষ্ট্রপতি, জিয়া বাংলাদেশে আসতে দেয়নি। কিন্তু তখন থেকেই শন ম্যাকব্রাইডের সঙ্গে আমার আলোচনা, একটা কথাই আমি বার বার তুলে ধরি যে, এই যে অস্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা, হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্র করা বা রাষ্ট্রপ্রধানকে খুন করা বা তাঁর পরিবারকে হত্যা করা এবং তার পর তাঁর ক্ষমতা দখল এই প্রক্রিয়াটা বন্ধ করা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তখন আমাদের এই আন্দোলনের লক্ষ্যটাই ছিল যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আমরা একটা অল পার্টি পার্লামেন্টারিয়ান গ্রুপও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গড়ে তুলেছিলাম, যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য। এছাড়া বিশ্বব্যাপী যখন যেখানে এধরনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর প্রতিবাদ করা এটাই আমাদের লক্ষ্য। বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমার যে আন্দোলন সংগ্রাম এই সংগ্রামের মূল কথাই হচ্ছে আমরা গণতন্ত্র চাই, ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হবে কিন্তু হত্যার মধ্য দিয়ে নয়। এই হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে হলে এর কুফল এটা তো সারাদেশে পড়ে, দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন আমার এটাই একটা প্রচেষ্টা। আমি যখন জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছি বা বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে বা পৃথিবীর বিভিন্ন সেমিনারে বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি আমি বিরোধী দলে থাকতেও আমার এই বক্তব্য ছিল, বিরোধী দলে থাকতেও আমি পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি এবং এই একই বক্তব্য, একই কথা, একই ক্যাম্পেন আমি বিশ্বব্যাপী করেছি যে আমরা গণতন্ত্র চাই। এই খুনখারাবির মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন এটা আমরা চাই না।
তারানা হালিম : আপনারা এই যে আজকে বত্রিশ নম্বরে এসেছেন, আমরা কিছুক্ষণ পরেই এখান থেকে হয়ত চলে যাব। আমরা চলে যাব কিন্তু আপনারা চলে গিয়েও বোধকরি এখানেই থেকে যাবেন। কারণ আপনাদের সঙ্গে এই বাড়ির যে স্মৃতি, এ বাড়ির মানুষগুলোর স্মৃতি সেগুলো আপনাদের সঙ্গে সর্বক্ষণই রয়ে যায়।
শেখ হাসিনা : এই বাড়ির স্মৃতি আমাদের মধ্যে কখনও মুছে যাবে না। মুছে যেতে পারে না। এই জায়গায় বসে কত কথা মনে হয়, যেমন কামাল, সারাদিন খেলাধুলায় কাটে। খুব শখ ছিল খেলাধুলা, গান গাইত। এখনও মনে হয় যেন আমি কান পেতে শুনতে পাই কামাল তার ঘরে বসে সেতার বাজাচ্ছে। চমৎকার সেতার বাজাত। অনেক সময় গভীর রাতে কামালের সেতারের বাজনা শুনতাম। সে বসে বসে আপন মনে সেতার বাজাচ্ছে অথবা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দরাজ গলায় গান গাইতে গাইতে। আধ্যাত্মিক গানগুলো সে খুব পছন্দ করত। এই গান গাইতে গাইতে সে চলত। জামাল আমাদের ছোট্ট ও একটু পাগলাটে ধরনের ছিল। নিজে হাঁটতে চলতে নাচত। ও আবার নাচতে খুব পছন্দ করত। ও কখনও চুপচাপ দাঁড়াতে পারত না। মনে হতো সবসময় সে নাচছে। আবার খেলনা নিয়ে খেলত, এত দুষ্টামি করত জামাল। একবার মনে আছে রেহানা জামালের ওপর খুব ক্ষেপে জামালকে মারতে গেল। জামাল তাকে দু’হাতে কোলে তুলে নিয়ে সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে, এই দেখ রেহানা আমাকে মারতে আসছে। সোজা কোলে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরাল। ও ছোট্ট বাচ্চাদের মতো খেলতে পছন্দ করত। এমনকি জয়কে নিয়েও এক জায়গায় বসে বসে গাড়িটাড়ি নিয়ে সারাদিন খেলাধুলা। আর রাসেল তো আমাদের সবার ছোট। আমাদের বাসার সবাই আমরা খুব বাচ্চাও পছন্দ করতাম। কাজেই রাসেল আসাটা যেন আমাদের জন্য, সকলের চোখের মণি, সকলের আদরের ধন। আমার এখনও মনে আছে রাসেল যেদিন প্রথম হাঁটা শেখে, তো সে প্রথম আমার আঙ্গুল ধরে এই বারান্দা দিয়ে হাঁটল। সারা বাড়িটা হাঁটল। হেঁটে হেঁটে একসময় সে আঙ্গুলটা ছেড়ে দিয়ে একা একা হাঁটা শুরু করে দিল। ও খুব সাবধানী ছিল। এমনিতে বাচ্চারা হাঁটা শিখতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায় ও তা করেনি। তার পরে সে যখন সাইকেল চালানো শুরু করল এই বাউন্ডারিটার ভেতরে, বিশেষ করে এই রাস্তটার উপরে শক্ত হয়ে বসে সে সাইকেল চালাত। সারা দিনরাত সাইকেল নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তার আর একটা শখ ছিল ঘুম থেকে উঠেই কবুতরকে খাবার দেয়া। ছোট থাকতেই সে আমার মায়ের কোলে বা আমাদের কোলে বা একটা বুয়া ছিল ওকে পালত তার কোলে বসে কবুতরকে খাবার দেবে।
তারানা হালিম : আপনার বাবা-মাকে আপনারই বাবা-মা হিসেবে কিছু বলবেন?
শেখ হাসিনা : আমার বাবা-মায়ের মতো বাবা-মা পৃথিবীতে হয় না। কারণ আমাদের জন্য তাদের ¯েœহ ভালবাসা, বাবা-মায়ের হাতে মারও খেতাম এটাও ঠিক, কিন্তু মায়ের আদর মায়ের ¯েœহ মায়ের ভালবাসা, আমি অনেক সময় ভাত খাব না বলে আলসেমি করতাম, মা কোলে বসিয়ে নিজের হাতে ভাত খাওয়াতেন। কত দিন হয়ত সন্ধ্যার সময় ঘুমিয়ে গেলাম, আব্বা এসে মাকে জিজ্ঞেস করতেন ও ভাত খায়নি, তুলে নিয়ে নিজে ভাত মাখিয়ে পাশে বসিয়ে বলতেন বসে বসে খাও এখন। আসলে আব্বা বাইরে আসলে যতটুকু থাকতেন, আদর ¯েœহ দিয়ে আমাদের ভরিয়ে দিতেন। আমার মায়ের তো তুলনাই নাই, শুধু আমরা কেন আত্মীয়স্বজন পরিবারের কারও কোথায় অসুখ বিসুখ সব দায়িত্ব যেন আমার মায়ের। খুব গান শুনতে পছন্দ করতেন, বই পড়তে পছন্দ করতেন, আমার মা খুব উপন্যাস পড়তেন। প্রচুর লেখাপড়া করতেন।
তারানা হালিম : আমরা জাতির জনককে হারিয়েছি সে বেদনা আমাদের আছে, সেই বেদনার পাশাপাশি এদেশের নাগরিক হিসেবে, তাঁর কন্যা হিসেবে এই যে দুই কন্যার বেদনা সে বেদনা আমরা কিছুটা ভাগ করে নেই। আপনারা যে বাড়িটায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর করলেন এর পেছনে কী চিন্তা কাজ করেছে?
শেখ হাসিনা : যখন ফিরে এলাম এবং বাড়িটা পেলাম আসলে এত স্মৃতিতে ভরা এ বাড়ি, আর এখানে সেই রক্তের দাগ। সব কিছু মিলিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করা, বা এ বাড়ি ভোগ করা এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তা ছাড়া আমার বাবা তো ছিলেন বাংলার জনগণের। তিনি তো নিজের জীবনটাই দিয়ে গেছেন বাংলার জনগণের জন্য। কাজেই আমরাও দুই বোন সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই বাড়িটা জনগণের জন্যই দান করে দিব এবং ট্রাস্ট করে এ বাড়িটা আজকে আমরা দান করে দিয়েছি। এখানে মিউজিয়াম হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি সেগুলো আমরা রাখব এবং আমার বাবা-মা, ভাই, কামাল ও জামালের স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, যারা এখানে জীবন দিয়েছে যেমন শেখ নাসের আমার একমাত্র চাচা, তিনি তো এই বাড়িতে মারা গেছেন, ১৫ আগস্ট তাঁকেও হত্যা করা হয়েছে। কামাল, জামালের যে নববধূ, জামালের বিয়ে তো এক মাসও হয়নি। বাচ্চা মেয়েরা বউ হয়ে এসেছে কত স্বপ্ন কত আশা সব শেষ হয়ে গেছে। এই যে এত স্মৃতি, ১৫ আগস্টে যখন এই বাড়ি আক্রমণ করে সেদিন যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, অনেক পুলিশের কর্মকর্তা মারা গেছেন, সিকিউরিটিতে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও মারা গেছেন। এত স্মৃতিভরা এই বাড়ি যেখানে একদিন আমরা সবাই মা-বাবা, ভাইবোন আনন্দে ভরা একটা ভরপুর সংসারে ছিলাম সেখানে দুই বোন একা এ বাড়িতে থাকা অসহনীয়।
শেখ রেহানা : আমরা দু’বোনে ঠিক করলাম যে আমাদের তো বেঁচে থাকার কথা ছিল না। এই বাড়িটা শুধু আমাদের স্মৃতিই নয়, এটা সমগ্র বাঙালীর বাংলার জনগণের স্মৃতিবিজড়িত। সেই বাষট্টির আন্দোলন থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৭১-এর আন্দোলন সব চিন্তা করলাম। আমরা যে কোন মুহূর্তেই যে কেউ চলে যেতে পারি, আর এটা তো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না। এমন একটা কাজে এটা দিয়ে যেতে চাই, আমাদের নতুন প্রজন্ম সবাই যেন ইতিহাস সঠিকভাবে জানতে পারে। এখানে থাকা যে কষ্টকর ব্যাপার সব কিছু মিলিয়ে মনে করলাম যে কিছু দিতে পারি নাই। বাবা তো বুকের রক্ত দিয়ে সবার ঋণ শোধ করে গেছেন। আমাদের জীবনে আর কী দেয়ার আছে আর কী হারানোর ও আর কী পাওয়ার আছে। এ বাড়িটি যদি দিয়ে দেই, সবাই ইতিহাস জানতে পারবে, সবার বুকে স্মৃতিটা থাকুক শুধু আমাদের দু’জনের বুকে কেন! সারা বাঙালীর মনে যেন এই বাড়িটা থাকে। আমরা তো জানি না সাড়ে তিন হাত মাটি জুটবে কিনা, সেটাও কেউ বলতে পারে না। কার কী ভাগ্যে থাকে। এটা থাকলে যতদিন বাংলাদেশ ও পৃথিবী থাকবে ততদিন এ বাড়িও থাকবে ইনশাল্লাহ্। সবার বুকে যেন এ স্মৃতি নিয়ে সবাই থাকতে পারে। আমাদের সামান্য বাড়িটুকু বাঙালীদের ট্রাস্ট করে দিয়ে গেলাম, যাতে ব্যক্তিমালিকানা না থাকে। সামান্য সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়াঝাটি মারামারি কাটাকাটি এটা যেন না হয়। এই বাড়িটা সব বাঙালীর এটাই মনে করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আমার দাদার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া ওটাও আমার ফুপাত ও চাচাত ভাইবোন সবার মতামত নিয়ে ওটাও দিয়ে দেয়া হচ্ছে। স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে ওটাকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
শেখ হাসিনা : যে টাকাপয়সা আমরা পেয়েছি সে টাকাপয়সা ট্রাস্ট করে ওই টাকা থেকে গরিব-দুঃখী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য সাহায্য করে যাচ্ছি। কারণ আমরা কিছু ভোগ করতে চাই না, আমাদের জীবনে কোন কিছু দরকার নেই।
শেখ রেহানা : অনেক কিছু পেয়েছি অনেক কিছু হারিয়েছি। রাতে প্রেসিডেন্টের মেয়ে ঘুমিয়ে সকালে দেখি কিছুই নেই। সর্বস্বান্ত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। সবকিছু দেখা হয়ে গেছে দুনিয়াতে। যতটুকু থাকি সবার দোয়া মানসম্মান নিয়ে বাকি জীবনটা যেন চলে যেতে পারি, এটুকুই চাওয়া বা কাম্য।
শেখ হাসিনা : আমরা দু’বোন মানুষের দোয়া চাই। আর আমরা মনে করি যে বাংলার জনগণই আমদের সব। তাদের কাছে আমাদের শুধু দোয়া চাওয়া আর তাদের জন্য যদি কিছু করে যেতে পারি এটাই আমাদের সার্থকতা। আমরা ব্যক্তিগত জীবনে কোন কিছু চাই না।
[১৫ আগস্ট ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার এই সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী তারানা হালিম।]

No comments

Powered by Blogger.