বেসরকারি শিক্ষকদের সমস্যা by এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শতকরা ৯০ ভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাকি ১০ ভাগ সরকারি। দেশের ১০ ভাগ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা সুযোগ-সুবিধা এবং স্ট্যাটাসে আর্য গোষ্ঠী; বেসরকারি বা বেদরকারিরা অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছেন দুঃখ-কষ্টের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে।


যারা দেশের ৯০ ভাগ ছাত্রছাত্রীকে পড়ান, অজপাড়াগাঁয়ে ভাঙাচোরা অবকাঠামোয় এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান করেন, তারা পাবেন সরকারি অনুগ্রহ, অনুদান।
বর্তমান সরকার ও তার শিক্ষামন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাদ জানাই একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য। ধাপে ধাপে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রের অচলাবস্থা দূর করার কার্যকরী পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ না করলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ একসময় বিস্টেম্ফারিত হবে। কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রীর উক্তি এবং বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যের কারণে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বঞ্চিত হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকলে যা অবস্থা হয়, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদেরও অবস্থা তদ্রূপ। বরিশাল বিভাগসহ বিভিন্ন স্থানে কালো ব্যাজ ধারণ করে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে তারা পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। এ সমস্যা-সংকট সমাধানে এখনই কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এ নীরবতার আগুন হঠাৎ স্টম্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠতে খুব বেশি সময় লাগবে না। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা যে সমস্যা-সংকট ও বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন, তার কিছুটা নমুনা সংক্ষেপে উপস্থাপন করছি।
ক. বেসরকারি কলেজ শিক্ষকরা সারাজীবন একটি মাত্র প্রমোশন পেয়ে থাকেন তাও ৫ :২ অনুপাতে। কেউ কেউ সারাজীবন প্রভাষক থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। অথচ সরকারি কলেজ শিক্ষকরা অতি সহজেই প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, প্রফেসর এমনকি সচিবও হতে পারেন।
খ. বেসরকারি কলেজ শিক্ষকরা পিয়ন থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পর্যন্ত বাড়িভাড়া পান ১০০ টাকা। লজ্জার এমনই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি-না সন্দেহ।
গ. সরকারি কলেজশিক্ষকদের বছর বছর ইনক্রিমেন্ট আছে, স্কেলের ৪০ থেকে ৫৫ শতাংশ বাড়িভাড়া পান, চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা সারাজীবন একটি ইনক্রিমেন্ট, বাসা ভাড়া ১০০ টাকা, মেডিকেল পুরনো স্কেলে ১৫০ টাকা পেয়ে আসছেন।
ঘ. সরকারি শিক্ষকরা পূর্ণাঙ্গ পেনশন, এক বছর এলপিআর, বছরে দুটি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সরকারি আনুকূল্য পান। অথচ বেসরকারিরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
ঙ. বেসরকারি শিক্ষকরা চাকরির দুই বছর পূর্তি হলে ২ বছর পর সিনিয়র স্কেল পেতেন এবং ৮ বছর পূর্তি হলে টাইম স্কেল পেতেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার এ বন্ধ টাইম স্কেল প্রদান করে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিলেন। কিন্তু গত ৭ মার্চ অর্থমন্ত্রী এক ঘোষণায় এ টাইম স্কেল স্থগিত করে প্রাপ্ত অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা বলে ৫ লক্ষাধিক শিক্ষককে এ দুর্মূল্যের বাজারে চরম হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন।
চ. বেসরকারি কলেজের ফল খারাপ হলে তাদের এমপিও স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু সরকারি শিক্ষকদের বেলায় এ নিয়ম প্রযোজ্য হয় না।
ছ. পুরনো বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকরা অবসরে গেলে জনবল কাঠামোর মরণফাঁদের কারণে নতুন শিক্ষক নেওয়া যায় না। বর্তমান সরকার আসার পর দ্বিতীয় শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হলেও গত ক'দিন আগে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম, কোনো এক জটিলতায় বর্তমানে এসব পদে এমপিওভুক্তি স্থগিত হয়ে গেছে। শিক্ষকস্বল্পতার কারণে বহু কলেজে শিক্ষার পরিবেশ বিঘি্নত হচ্ছে।
জ. দেশজুড়ে বিজ্ঞান শাখায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ করতে গেলে ছাত্র সংখ্যার অজুহাতে নতুন শিক্ষক এমপিওভুক্ত করা হয় না।
ঞ. বেসরকারি শিক্ষকদের মাস শেষে বেতন পাওয়া অনিশ্চিত থাকে। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে পরিবার নিয়ে তাদের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়।
এভাবেই নানা বঞ্চনার কষ্ট বুকে নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকরা দীর্ঘদিন থেকে স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন। জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে বেসরকারি শিক্ষকরা এগিয়ে আসছেন। কিন্তু নিজের রুটিরুজি এবং বাঁচার দাবিতে শিক্ষকদের রাস্তায় নামা, ধর্মঘট, অনশন করা বর্তমান সরকারের আমলে আমাদের কাম্য ছিল না।
হ উপাধ্যক্ষ, নিমসার জুনাব আলী কলেজ, কুমিল্লা
 

No comments

Powered by Blogger.