অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসাবিরোধী অভিযানঃ আসলে হচ্ছেটা কী

অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার খপ্পরে পড়ে সরকার প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখির পটভূমিতে বিভিন্ন সময় এ অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট লোকজনকে আটক করা হয়েছে। তবে এতে লাভ-ক্ষতি কী হয়েছে, জব্ধ করা যন্ত্রপাতি কোথায় গেল ইত্যাদি বিষয় এখনও অস্পষ্ট।

সম্প্রতি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা সম্পর্কে বিরোধী দলের চিফ হুইপের সংসদের ভেতরে ও বাইরে দেয়া একটি বক্তব্য নিয়ে তুলকালামকাণ্ড শুরু হওয়ার পাশাপাশি কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা ‘নির্মূল’ করার লক্ষ্যে হঠাত্ করে ল্যান্ডফোন কোম্পানি নামে পরিচিত পাবলিক সুইচড টেলিফোন অপারেশন (পিএসটিএন) কোম্পানিগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় বিষয়টি আবার আলোচনার সামনে চলে এসেছে।
ঢাকায় যথাযথ সরকারি অনুমতি নিয়ে দেশীয় অর্থায়নে গড়ে ওঠা ১১টি ল্যান্ডফোন কোম্পানি ব্যবসা শুরু করেছিল। ভবিষ্যতে লাভ হবে এই আশায় কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে বিনিয়োগ করেছে ৩ হাজার কোটি টাকার মতো। কোম্পানিগুলোতে মোট কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এর মধ্যে ৬টি কোম্পানি নানা জটিলতায় এমনভাবে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে, এগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় বলা যায়। বাকি ৫টি কোম্পানি ওয়ার্ল্ডটেল, ঢাকা ফোন, র্যাংকসটেল, পিপলসটেল এবং ন্যাশনাল ফোনের প্রধান সুইচ রুম সিলগালা করেছে বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার অভিযোগে। ফলে তারবিহীন ল্যান্ডফোনভিত্তিক টেলিযোগাযোগ খাতে বেসরকারি দেশীয় উদ্যোক্তাদের একেবারে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার দশা হয়েছে। প্রায় নিষ্ক্রিয় বাকি ৬টি কোম্পানিও বন্ধ করে দেয়া হবে, বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমন হুমকি দেয়ায় বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি আসলে বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে। অবশ্য একাধিক রিট মামলায় হাইকোর্টের ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ পেয়ে বিটিআরসি পিছু হটেছে। বন্ধ করে দেয়া কোম্পানিগুলোর সুইচ রুম মঙ্গলবার থেকে খুলে দিয়েছে। কিন্তু সৃষ্ট জটিলতা কাটিয়ে উঠে কোম্পানিগুলোর পক্ষে ৫ লাখের বেশি গ্রাহককে সার্ভিস দিতে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এর ফলে গোটা বেসরকারি ল্যান্ডফোন খাতের দেশীয় বিনিয়োগ অবশ্যই বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। প্রথমত, কোম্পানিগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায় ছন্দপতন ঘটেছে। তৃতীয়ত, বর্তমানের এবং সম্ভাব্য গ্রাহকদের আস্থায় চিড় ধরেছে। এই ধকল কাটিয়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ। আবার নতুন ‘অভিযান’ শুরু হলে সে সময় আর না-ও আসতে পারে।
বিগত জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে যখন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা বাণিজ্য লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছিল, আমরা সেই সময় থেকে একটা কথা বার বার বলে আসছি, দেশীয় উদ্যোগে জাতীয় পুঁজির সমাবেশ ঘটা ও বিকশিত হওয়ার প্রথমপর্ব দুনিয়ার কোনো ধনবাদী দেশেই ন্যায়শাস্ত্রের ব্যাকরণ মেনে সম্পন্ন হয়নি। বনেদি ইউরোপ, আধুনিক আমেরিকা ও জাপান থেকে শুরু করে হালের দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা সমান সত্য। এর বিপরীতে আমাদের দেশে মাঝে মধ্যেই দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে অতি তুচ্ছ ছলছুতায় দেশীয় উদ্যোগের মাথায় আঘাত হেনে কার্যত বাংলাদেশকে বিদেশি পুঁজির চারণক্ষেত্র বানিয়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশীদের বাধ্য করা হচ্ছে বিদেশি পুঁজির সেবাদাস হয়ে জীবন ‘ধন্য’ করার জন্য। ব্যাপারটা পরাধীন দেশের জন্য মানানসই হতে পারে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের উদ্যোক্তাদের সামনে যদি ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’ হয়ে ‘সাফল্য’ অর্জন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা না থাকে তবে জাতীয় অর্থনীতির অপুষ্টি রোগ কিছুতেই সারবে না। বিটিআরসি কি সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে?

No comments

Powered by Blogger.