কোরআন হাতে হরতাল! by শাহীন হাসনাত

প্রস্তাবিত নারীনীতি, হাইকোর্টের ফতোয়াবিরোধী রায় ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আহূত ৪ এপ্রিলের হরতালে আমরা ভয়ঙ্কর একটি বিষয় প্রত্যক্ষ করলাম। তা হলো_ পবিত্র গ্রন্থ কোরআনুল কারিম হাতে নিয়ে হরতালে পিকেটিং।
এই পিকেটারের তালিকায় অসংখ্য অবুঝ নাবালক বাচ্চাও ছিল, যাদের বয়স সাত থেকে পনেরোর নিচে। এই কাজগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ও ছোট শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হরতালের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে কোন ইসলামের মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা? এভাবে কি সত্যিই কোরআনের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে?
আবহমানকাল থেকেই দেখে আসছি, কোনো মুসলমানের কাছ থেকে অনিচ্ছায় বা অসাবধানতাবশত কোরআনুল কারিম মাটিতে পড়ে গেলে তা তুলে পরম যত্নে বুকে-মুখে লাগান, অনেকেই আবার কোরআনের ওজন পরিমাণ চাল আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন। এটা মূলত কোরআনের প্রতি মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বস্তুত কোরআন শরিফ আল্লাহর এক শাশ্বত ও চিরন্তন কিতাব। কোরআন শরিফ সব ধরনের বিকৃতি এবং মানুষের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন থেকে মুক্ত ও সংরক্ষিত। কোরআন শরিফ যেমনটি নাজিল হয়েছিল, তেমনটিই রয়েছে এবং চিরকালই তা থাকবে। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা এই কিতাবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনেই ইরশাদ হচ্ছে_ 'আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং নিশ্চয়ই আমিই এর সংরক্ষক।'
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। আমাদের দেশের গুটিকয়েক ধর্মীয় নেতা এমন একটি বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়েছেন, যা মানুষের তামাম ক্ষমতার ঊধর্ে্ব। আর সরকারও এ ইস্যুতে দায়িত্বহীনতা ও অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছে, যা কোনো অবস্থাতেই শুভ লক্ষণ নয়।
হরতাল চলাকালে মাদ্রাসার ছাত্ররা যেভাবে এক হাতে কোরআন নিয়ে কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় পিকেটিংয়ে নেমেছিল, তা দেখে যে কোনো বিবেকবান মানুষেরই গা শিউরে ওঠার কথা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এসব পিকেটারকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও লিপ্ত দেখা গেছে। দেখা গেছে, পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে এসব পিকেটার কোরআন শরিফকে ঢাল বা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ধর্মীয় নেতা ইতিমধ্যে বলেছেন, 'কোরআন হাতে হরতাল করা অনুচিত।' একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে নামা উচিত হয়নি। পিকেটারদের হাত থেকে যেভাবে কোরআন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তা স্পষ্টত কোরআনের অবমাননা। ইসলাম এ ধরনের কাজের অনুমতি দেয়নি। এখন প্রশ্ন উঠছে, সাত বছরের শিশু থেকে শুরু করে মাদ্রাসার ছাত্রদের যেভাবে রাস্তায় নামানো হলো এ দায়ভার কে বহন করবে? কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা আর কতদিন অন্যের ক্ষমতা অর্জনের জোয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হবে? কওমি মাদ্রাসা তো কোনো ব্যক্তিবিশেষের মজুদ শক্তি নয়।
একটি কথা বলে রাখা ভালো, 'রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্মপ্রাণ মানুষের উপস্থিতি জরুরি। হন তিনি পাদ্রি, ভিক্ষু, ঠাকুর, পোপ কিংবা ফকির-দরবেশ। তাদের উপস্থিতি অসহ্য ভাবা অন্যায়। তদুপরি এ দেশে আলেম-ওলামারা শ্রদ্ধার পাত্র। তাই আলেম-ওলামাদের মর্যাদা নষ্ট করা হলে সমাজে ভারসাম্যহীনতা রোধ করা যাবে না। ঠিক তেমনি সামান্য অজুহাতেই হাতে কোরআন নিয়ে, ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করা যাবে না। এ বিষয়ের প্রতি রাষ্ট্র ও ধর্মীয় নেতাদেরও শক্তভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.