আমাদের স্বপ্ন কি এতই বড়? by জাকারিয়া পলাশ

'তোমাকে বেশ ভালো মানুষ মনে হয়। তুমি কেন রাজনীতির মতো নোংরা ও জঘন্য কিছুর সঙ্গে জড়ালে?'_ প্রশ্নটি আমার নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথমবার রাজ্যসভা নির্বাচনে অংশ নিলে তার কাছে জনগণের প্রশ্ন ছিল এটি। 'প্রত্যাশার স্পর্ধা' (দ্য অ্যাডিসিটি অব হোপ) গ্রন্থে ওবামা রোমন্থন করেছেন প্রশ্নটি।


অর্থাৎ রাজনীতি জিনিসটিকে নোংরা ও জঘন্য হিসেবে আমেরিকার মানুষও মনে করে। কারণ সেখানেও আছে জনগণের সামনে কথা দিয়ে কথা না রাখার নজির। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার চেয়ে নির্বাচনী ফান্ডের ডোনার, ধনকুবের আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায়ই তাদের মনোযোগ থাকে বেশি। জনসেবা নয়, রাজনীতি যেন এক রকম নিজ স্বার্থ হাসিলের ধান্ধা। ওবামার দিকে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জনতা তাকে রাজনীতি থেকে ফেরাতে পারেনি। বরং বদলে দেওয়ার এক ভুবন ভোলানো স্লোগান দিয়ে বিশ্ব মাতিয়ে রাজ্যসভাই শুধু নয়, খোদ হোয়াইট হাউসে আসন গেড়েছেন তিনি। কিন্তু সমাধান হয়নি বেকারত্ব সমস্যার। ওয়ালস্ট্রিট উত্তপ্ত রয়েছে এখনও। জনগণের কাছে দেওয়া তার কথা কতটুকুইবা রাখতে পেরেছেন তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর হিসাব-নিকাশ। মানে আধুনিক গণতন্ত্রের পীঠস্থানও আজ গণতন্ত্রের সংকট পুরোপুরি মোকাবেলা করতে পারেননি। তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদদের দিকেই কেবল অভিযোগের তীর ছুড়ে লাভ কী? অবশ্য আমি রাজনীতিবিদদের সাত খুন মাফ করার ঘোষণা দিতে চাই না। শুধু বলতে চাই, রাজনীতিকদের পাশাপাশি জনগণেরও দায় আছে। গণতন্ত্র তো শুধু রাজনীতিবিদদের বিষয় নয়। গণতন্ত্রে জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বড় এক সমস্যা রয়েছে। তা হলো জনগণ মনে করে সব কাজই সরকার করে দেবে। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা কার্যক্রম, দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিচার-সালিশ, কোর্ট-কাছারির কাজ সবই সরকারের দায়িত্ব। সচেতন জনগণ কেবল তার অধিকার অধিকার বলে চেঁচাবে। আর অসচেতনদের তো পেটের ভাতের খোঁজে জীবন পার। জনগণের মাঝে এ অধিকার সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আবার কাজ করছে হাজারো এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অধিকার সচেতনতার আগে রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের দায়িত্ব সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি পিছে পড়ে যাচ্ছে সর্বদাই। আইন-কানুন, আচার-বিচার মেনে চলার অভ্যাস ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের। এখানে যেমন আইন আছে, আইন ভাঙার ফাইনও আছে। এ কারণেই সরকার আর জনগণ পরস্পর বন্ধু হতে
পারছে না।
তবে আমাদের রাজনীতিকদের সঙ্গে ওবামার একটা বড় পার্থক্য আছে। তাহলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার একটা রূপরেখা তার কাছে থাকে। জনগণকে কথা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর একেবারে ইউটার্ন নিয়ে ভুলে যাননি তিনি। দেশের মানুষের প্রত্যাশার নূ্যনতম অঙ্কটি অন্তত হিসাব করে রেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, 'মানুষগুলোর স্বপ্নের সীমানা কতটা ক্ষুদ্র। তারা অপরাধী ও সন্ত্রাসী থেকে নিরাপদে থাকতে চান। শুদ্ধ বাতাসে, বিশুদ্ধ পানি এবং নিজের সন্তানের সঙ্গে আরও বেশি করে সময় কাটাতে চান। আর চান, যখন বুড়িয়ে যাবেন তখন যেন মর্যাদা ও আত্মসম্মানের সঙ্গে অবসর জীবনটি কাটাতে পারেন।' পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য দেশের মানুষের প্রত্যাশা এটুকু। আমাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষা কি এর চেয়ে বেশি? আমরা কী চাই আমাদের নেতারা কি তা জানেন? সব নেতাই হয়তো জানেন বলে দাবি করবেন। কারণ তাদের বক্তৃতায় সবসময় শোনা যায় আমাদের স্বাধীনতার চেতনার কথা। ক্ষুধা, দারিদ্র্যমু্ক্ত সোনার বাংলার কথা। কিন্তু আজ জনগণের নিরাপত্তা কোথায়? বেডরুমে খুন হয় নিয়মিত। তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না সরকার। চাকরির নিশ্চয়তা নেই। সেখানেও আছে ছাঁটাই
হওয়ার ভয়।
একদিকে রাজনীতিকদের স্বার্থপরতা, অপরদিকে জনগণের দায়িত্বহীনতা_ এই দুয়ের সুযোগ নিয়ে হিলারি, মমতা, ড্যান মজীনারা আলাদীনের চেরাগ হাতে আমাদের উন্নয়নের অঙ্ক কষবে। আর আমরা হবো মেরুদণ্ডহীন। নখদন্তহীন এক বাঙালি নামধারী টাইগার।
স জাকারিয়া পলাশ : শিক্ষার্থী ও বিতার্কিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
zpolashju@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.