কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আমার ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়- যুদ্ধাপরাধী বিচার- সাক্ষী মোশাররফ তালুকদারের সাক্ষ্য

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী মোঃ মোশারফ হোসেন তালুকদার তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার বড় ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার শেষের দিকে


শেরপুর আলবদর বাহিনীর প্রধান কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।’ ‘আমার ভাই গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে শেরপুরের মৃগী নদীর ওপর শেরী ব্রিজের ওপর নিয়ে গিয়ে প্রথমে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে পরে বেয়নেট দিয়ে ডান পায়ের হাঁটুর নিচের মাংসপেশী কেটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।’ বুধবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত গোলাম মোস্তফা তালুকদারের ছোট ভাই মোশারফ হোসেন তালুকদার তাঁর জবানবন্দীতে এসব কথা বলেন। জবানবন্দী শেষে সাক্ষী মোশারফ হোসেন তালুকদারকে জেরা শুরু করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট কফিলউদ্দিন চৌধুরী। অসমাপ্ত রেখে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেছে ট্রাইব্যুনাল। এর আগে সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক বিএনপি আমলের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী আব্দুল মোমেনকে জেরা শেষ করেছে আসামি পক্ষ।
জবানবন্দীর শুরুতে সাক্ষী মোশারফ হোসেন তালুকদার বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা চার ভাইবোন ছিলাম। বড় ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা আমাদের সবার বড় এবং আমি দ্বিতীয়। ১৯৭১ সালে আমি শেরপুর জিকে উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। তখন আমরা শেরপুর শহরেই বসবাস করতাম। আমার বড় ভাই গোলাম মোস্তফা তখন ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয়বর্ষে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন এবং রেডিও রাজশাহীতে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। সাক্ষী বলেন, ‘আমার বড় ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা ১৯৭১ সালে পরে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্রসহ এক -দেড় মাস পরে আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তখন আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘এর কয়েকদিন পর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ ভাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন।’
জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার বড় ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদার শেরপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। পরীক্ষার শেষ দিকে ১৯৭১ এর ২৩ আগস্ট মাগরিবের নামাজের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতে রেডিওর ব্যাটারি কেনার জন্য শেরপুর কলেজের মোড়ে একটি মুদি দোকানে যান। এ সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহের আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক ও শেরপুর আলবদর বাহিনীর প্রধান কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা আমার বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যায়।’ সাক্ষী বলেন, ‘আমার ভাইকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর বিষয়টি জানতে পেরে আমাদের দূর সম্পর্কের চাচা শান্তি কমিটির সদস্য তোফায়েল ইসলামের কাছে যাই। তিনি আলবদর ক্যাম্পে যান এবং আমার ভাই গোলাম মোস্তফা তালুকদারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমার ভাইকে দু’ রাকাত নফল নামাজ পড়ান। তারপর তিনি ওই ক্যাম্পে কামারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। দেখা করার পর আমার ভাইকে ছেড়ে দিতে কামারুজ্জামানকে অনুরোধ করেন তিনি। তার পর বলেন, কামারুজ্জামান তুমি, আমি, মোস্তফা তো একই এলাকার। তারপর কামারুজ্জামান সাহেব আমার চাচাকে বলেন, যা বলেছেন আর বলবেন না, এখন আপনি এখান থেকে চলে যান। তারপর আমার চাচা তোফায়েল ইসলাম শান্তি কমিটির লিডার ডাক্তার সামিদুল হককে সঙ্গে করে গোলাম মোস্তফাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। তিনিও কামারুজ্জামানকে অনুরোধ করে আমার ভাইকে ছাড়াতে ব্যর্থ হন।’
সাক্ষী মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ওই দিন (২৩ আগস্ট) রাতেই কামারুজ্জামান কয়েকজন আল-বদর সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে আমার ভাই গোলাম মোস্তফা ও তাদের এলাকার আবুল কাশেমকে শেরপুর মৃগী নদীর ওপর শেরী ব্রিজে নিয়ে যায়। সেখানে তার ভাইয়ের ডান পায়ের হাঁটুর নিচের মাংসপেশী বেয়নেট চার্জ করে কেটে ফেলা হয়। এরপর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই সময় আবুল কাশেমের ডান হাতের আঙুলে গুলি লাগে। তিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। স্বাধীনতার পর আবুল কাশেম তাদের বাড়িতে এসে গোলাম মোস্তফার হত্যাকা-সহ অন্যান্য ঘটনার বর্ণনা দেন।’ সাক্ষী বলেন, পরদিন ২৪ আগস্ট দুপুরের আগে তাদের গ্রামের তারা ভাইসহ কয়েকজন লোক এসে শেরী ব্রিজের পূর্ব-উত্তর কোনায় নদীর পাড় থেকে শহীদ গোলাম মোস্তফার লাশ উদ্ধার করে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন তিনি তার ভাইয়ের শরীরের গুলি ও আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর সম্ভবত আমার মা অথবা বাবা বাদী হয়ে থানায় কামারুজ্জামানসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করে গোলাম মোস্তফা হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। ২০১১ সালের শেষের দিকে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকের কাছে শেরপুর সদর থানায় বসে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে একটি জবানবন্দী দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক, শেরপুর আলবদর বাহিনীর প্রধান এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা, ওই অঞ্চলে আলবদর টর্চার ক্যাস্পের নিয়ন্ত্রক এবং আমার ভাই শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদারের হত্যাকারী কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীদের নিয়ে যে সব মানবতাবিরোধী অপরাধ ১৯৭১ সালে সংঘটন করেছে তার বিচার চাই। কামারুজ্জামানকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সাক্ষী তাকে কাঠগড়ায় শনাক্ত করেন।

জেরা
রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী মোশারফ হোসেন তালুকদারের জবানবন্দী শেষে তাকে জেরা করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী এ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী।
প্রশ্ন : আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি?
উত্তর : এসএসপি পাস।
প্রশ্ন : আপনার পেশা কি?
উত্তর : পেশায় আমি একজন ঠিকাদার।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামান এবং আপনারা তো একই ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন?
উত্তর : সত্য নয়, ওনার বাড়ি আমাদের পাশের ইউনিয়নে ছিল।
প্রশ্ন : আপনার এবং তাদের বাড়ির দূরত্ব কত?
উত্তর : দেড় থেকে দুই কিলোমিটার।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে আপনি তাকে বা তার পরিবারের সদস্যদের চিনতেন?
উত্তর : তার পরিবারের মধ্যে দু’জনকে চিনতাম।
প্রশ্ন : কিভাবে চিনতেন?
উত্তর : ১৯৭১ সালের চার বছর পূর্বে তেঘরিয়া মাদ্রাসায় এক ধর্মসভায় কামারুজ্জামান সাহেব উপস্থিত ছিলেন, আমিও সেখানে গিয়েছিলাম। আর সেখানেই তাকে প্রথম দেখেছি এবং তার এক ভাই আমাদের শহরের টিনের বাড়ি নির্মাণের সময় মিস্ত্রির সঙ্গে যোগালির কাজ করেছিল আর সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয়।
প্রশ্ন : আপনাদের ঘর কোন বছর নির্মাণ করা হয়েছে?
উত্তর : ১৯৭০ সালে।
প্রশ্ন : আপনাদের শহরের জায়গাটা কত সালে কার নামে কেনা হয়েছে?
উত্তর : আমার জানা মতে ১৯৬৮ সালে আমার মা ও আমার নানির নামে কেনা হয়েছে। পরে নানি তার অংশটুকু আমার মায়ের নামে লিখে দিয়েছেন।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আপনাদের শহরের বাড়িতে কে থাকতেন?
উত্তর : খালি থাকত, আমি মাঝে মাঝে সাইকেলে করে দেখে আসতাম।
প্রশ্ন : যুদ্ধের সময় আপনাদের শহরের বা গ্রামের বাড়িতে কি কোন লুটপাট বা অগ্নিসংযোগ হয়েছে?
উত্তর : গ্রামের বাড়িতে কিছু হয়নি, তবে শহরের বাড়িতে লুটপাট হয়েছে।
প্রশ্ন : কারা লুটপাট করেছে জানেন কি?
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনাদের গ্রামের বাড়িতে তো যুদ্ধের সময় আপনার বাবা-চাচাসহ তালুকদার বংশের অনেক লোক বসবাস করত?
উত্তর : হ্যাঁ, করত।
প্রশ্ন : আপনার বংশের মধ্যে আপনার ভাই ছাড়া কেউ তো সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।
উত্তর : এটা সত্য।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের মতো মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশ না নিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং তাদের সোর্স দিয়ে পরীক্ষার্থীদের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছে, তারা বলেছে যারা পরীক্ষায় অংশ নেবে তাদেরও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে ধরে নেয়া হবে, পরীক্ষা বাতিল করা হবে এবং অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটা কি আপনি জানেন?
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : এ পরস্পরবিরোধী প্রচারণার কারণে মাত্র ২০% পরীক্ষার্থী ওই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। আপনি কি তা জানেন?
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের সেই পরীক্ষা বাতিল করে ১৯৭২ সালের মে মাসে পুনরায় পরীক্ষা নেয়া হয় আপনি কি তা জানেন?
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনি কি জানেন কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিলেন?
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : কামারুজ্জামান ’৭০, ’৭১, ’৭২ সালে কি করতেন?
উত্তর : ’৭২, ’৭৩ সালে তিনি কারাগারে ছিলেন।
প্রশ্ন : আপনার মা তো শেরপুর ঘাতক-দালাল নির্র্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।
উত্তর : এটা সত্য।
প্রশ্ন : কত বছর ছিলেন?
উত্তর : মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
প্রশ্ন : ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কবে গঠন হয়েছিল?
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : কামারুজ্জামান কি আপনাদের এলাকায় জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, করছেন।
প্রশ্ন : ২০০৮ সালে কামারুজ্জামান ১ লাখ ১১ হাজার ভোট পেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন, তা কি আপনি জানেন?
উত্তর : নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন তবে ভোট কত পেয়েছেন তা আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনাদের কেন্দ্রে তো বেশি ভোট পেয়েছেন।
উত্তর : আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : দেখেন ২০০৮ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে আপনাদের শহরের বাসাটি তো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ক্যাম্প ছিল।
উত্তর : এটা সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকার নির্বাচিত এমপি এখনও শেরপুর শহরে গেলে আপনাদের বাড়িতে যান?
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : এমপির সুপারিশে আপনি একটি হাইস্কুলের সভাপতি হয়েছেন?
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার কমিটি অনুমোদনের জন্য এমপি সুপারিশ করে ঢাকায় পাঠিয়েছেন?
উত্তর : নিয়ম অনুযায়ী পাঠিয়েছেন।
জেরা শেষ না হওয়ায় তা অসমাপ্ত রেখে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-২। উল্লেখ্য, গত ১৫ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এর আগে চারজন তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। তাঁরা হলেনÑহামিদুল হক, মনোয়ার হোসেন খান মোহন, জহিরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক ও ফকির আব্দুল মান্নান। পরে তাদের জেরা করে আসামিপক্ষের আইনজীবী।

No comments

Powered by Blogger.