সময়ের প্রতিধ্বনি-জনগণের নয়, দুর্নীতির টাকায় পদ্মা সেতু হোক by মোস্তফা কামাল

বিষয়টা গভীর উদ্বেগের। এই উদ্বেগ ও শঙ্কা আমার একার নয়, এ দেশের প্রত্যেক সচেতন মানুষের। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণার পর সারা দেশে যা শুরু হয়েছে, তা রীতিমতো ন্যক্কারজনক। এ পরিস্থিতি এখনই সামাল দিতে না পারলে দেশব্যাপী অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে খুব একটা সময় লাগবে না।


পদ্মা সেতুর চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে এরই মধ্যে (১৬ জুলাই) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং তাতে আবদুল্লাহ আল হাসান নামে একজন নিহত হয়েছে। খুবই মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের আরো কত ঘটনা আমাদের দেখতে হয় কে জানে!
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে একজন অতি সাধারণ মানুষও এখন উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চান, 'ভাই, দেশটা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে! গণতন্ত্র থাকবে তো! নাকি আবার কোনো অরাজনৈতিক শক্তি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসবে?' আবার কেউ কেউ বলছেন, 'প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ এত বিপ্লবী হয়ে উঠলেন! তাঁর শক্তির উৎস কী? নাকি নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠার মতো অবস্থা তাঁর! তিনি কি টের পেয়ে গেছেন, তিনি আর ক্ষমতায় আসতে পারবেন না! নাকি পেছন থেকে বিশেষ কোনো শক্তি তাঁকে উৎসাহ জোগাচ্ছে! জনগণ পেছনে না থাকলে কোনো শক্তিই যে কাজে আসবে না, তা নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা ভালো জানেন।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বীরোচিত বক্তব্য দিয়েছেন, তা রাজনৈতিক স্টান্টবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর বক্তব্য বাস্তবসম্মতও নয়। প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি পারমাণবিক বোমা তৈরি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জনগণের পেটে ছালা বেঁধে হলেও পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে। অর্থাৎ জনগণ না খেয়ে থাকলেও বোমা তৈরি করা হবে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলেও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় পাকিস্তানের নাম রয়েছে। বাংলাদেশের যেন সেই পরিণতি না হয়।
তা ছাড়া সরকারের ভুলের খেসারত জনগণ কেন দেবে? সরকারের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো, তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? কেন তখন মন্ত্রীর পক্ষেই সাফাই গাওয়া হলো? তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক তো দুর্নীতির অভিযোগ অনেক আগেই করেছিল। তখন কেন সরকার চুপ ছিল? এক বছর আগেই তো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত! গত এক বছরে দেনদরবার তো কম করা হয়নি! বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করেছে। তখনই তো সরকার ঘোষণা দিতে পারত, আমরা বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়াই পদ্মা সেতু করব। এত দিন কেন অপেক্ষা করা হলো? এখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিশ্বব্যাংক কেন দেরি করিয়েছে সে জন্য মামলা করা উচিত।
নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণার পর থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা সারা দেশে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। সর্বত্র এখন এক আলোচনা, 'চাঁদা দিন, পদ্মা সেতু গড়ুন।' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, অফিস-আদালতে চাঁদাবাজি শুরু হয়ে গেছে। সরকারের লোকেরা একধরনের জুলুম করছে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা টাকা দেবে কোত্থেকে? যাদের পেটে ভাত নেই তাদের পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখিয়ে কী লাভ!
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলেও বলা হয়, জানেন না! পদ্মা সেতুর জন্য বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। এসব কী শুরু হয়েছে দেশে! এর মানে লুটপাটের আরেক পন্থা আর কি! কিন্তু এই দরিদ্র দেশের জনগণ কেন পদ্মা সেতুর অর্থ দেবে?
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমলে যে দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে নাকি তিনটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। আমাদের তিনটি দরকার নেই। আপাতত একটি পদ্মা সেতুই করা হোক। সরকার বিনিয়োগের স্বার্থে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করে সেই অর্থ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় করা হোক। এই দাবি এখন সাধারণ মানুষও জানাচ্ছে।
এটা সরকারের জন্য একটা বড় সুযোগও বটে! এর ফলে অনেক দিক থেকেই সরকার লাভবান হতে পারে। এক. বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের কাছে আর ধরনা দিতে হবে না; দুই. দরিদ্র জনগণের মাথায়ও পদ্মা সেতুর বিশাল বোঝা চাপবে না এবং এর ফলে চাঁদাবাজি, লুটপাট বিশৃঙ্খলা বন্ধ হবে এবং তিন. পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে শুরু করতে পারলে তা আগামী নির্বাচনে দলের পক্ষে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে পারবেন, 'আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণসহ অনেক উন্নয়নকাজ শুরু করেছি। দেশকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছি।'
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর এমনিতেই সরকার খুব বেকায়দায় আছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের ভাবমূর্তি নাজুক। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা দেখলেই তা অনুমান করা সম্ভব। প্রথমে বিশ্বব্যাংক সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরকারকে বড় ধরনের চাপে ফেলে। এই অভিযোগ নিয়ে টানা প্রায় এক বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ পেরেক ঠুকেছে আকস্মিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে। এর পর পরই মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে সরকারের কর্মকাণ্ডের তুখোড় সমালোচনা করা হয়।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরাসরি র‌্যাবের কর্মকাণ্ড ও বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের সুপারিশ করে। একটি স্বাধীন দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করার এখতিয়ারই ওই প্রতিষ্ঠানটির নেই। এর পরও কেন বিতর্কিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলো, তা রহস্যজনক। তবে এসব কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশকে নিয়ে কত বড় ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু সরকার এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা ট্যাকল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
আঞ্চলিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, এটি একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার দেশ। এখানে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেও এ দেশটির প্রতি বিশ্বের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র জয়ের পর আমেরিকার কাছে আমাদের গুরুত্ব বহু গুণ বেড়ে গেছে। কারণ তারা বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে একটি স্থায়ী কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। চীনকে সামাল দিতে এ ধরনের কাঠামো তাদের খুবই দরকার। সপ্তম নৌবহরের প্রসঙ্গটি এমনিতেই আলোচনায় আসেনি। এর নেপথ্যে অনেক কারণ রয়েছে। ভেতরে ভেতরে চলছে অন্য খেলা।
এশিয়া অঞ্চলে চীনের খবরদারি অথবা বিশাল সমুদ্রজুড়ে চীনের রাজত্ব আর মানতে পারছে না আমেরিকা। ভারতের একার পক্ষে চীনের সঙ্গে বোঝাপড়া করাও সম্ভব নয়। এ কারণেই আমেরিকাকে পাশে রেখে ভারত ফায়দা হাসিল করতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় আমেরিকার উপস্থিতি আপাতত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে না ভারত। হিলারি ক্লিনটনের আকস্মিক ঢাকা সফরের নেপথ্যে এটি একটি বড় কারণ। বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান নৌঘাঁটি স্থাপন করতে পারলে এ অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে চতুর্মুখী চাপে রেখেছে। পাশাপাশি দেনদরবারও চলছে। বাংলাদেশকে বোঝানো হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহরের উপস্থিতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নৌসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মার্কিন প্রস্তাবে রাজি হলে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহ আরো অনেক কিছুই পাবে বাংলাদেশ। আর রাজি না হলে অর্থনৈতিক অবরোধের মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের কয়েক দিন পরই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশি পোশাক কিনে ঝুঁকি নিতে চান না মার্কিন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা তৈরি পোশাক শিল্পে উন্নত পরিবেশ দেখতে চান। দেখতে চান, এখানে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ও হরতালমুক্ত পরিবেশ। তাঁর বক্তব্যে একধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ইঙ্গিত ছিল। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। বেশির ভাগ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিলে দেশ মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে না বইতেই দেশটির ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে নানা ফন্দি আঁটা হচ্ছে! এসবের মানে কী! চাপে ফেলে বাংলাদেশের কাছ থেকে স্বার্থ আদায় করা! বাংলাদেশ নিশ্চয়ই তার সার্বভৌমত্ব অন্য দেশের হাতে তুলে দেবে না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে জাতি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সে জাতি নিশ্চয়ই কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নোয়াবে না।
অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময়ই মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে গোপনে চুক্তি হয়ে গেছে। এখনো অনেকে এ কথা বিশ্বাস করেন। অনেকে বলেন, হিলারির সময় চুক্তি হয়নি। তাই মার্কিন নৌপ্রধান ঢাকায় এসেছেন। বড় কোনো 'ডিল' না হলে সাধারণত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের সফর হয় না। এর মানে 'ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!'

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.