সপ্তাহের হালচাল-পাকিস্তানেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার? by আব্দুল কাইয়ুম

পাকিস্তানে গণতন্ত্র টেকে কি টেকে না, এ অবস্থা চলছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ জানা গেল যে সেখানে আগাম নির্বাচনের একটা চিন্তাভাবনা চলছে। নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বসে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তারা দুটি বিষয়ে একমত হয়েছে। প্রথমত, নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।


এর প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন আসমা জাহাঙ্গীর। তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি; পাকিস্তানের মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা। ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ আসমা জাহাঙ্গীরকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে মতৈক্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। (সূত্র: জি-নিউজ ডট কম, ১৬ জুলাই, ২০১২)।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীদের কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা সদস্য হবেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁদের কোনো সক্রিয় সংশ্রবও থাকবে না। এই শর্তটি আরোপ করা হয়েছে যেন নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর মানুষের আস্থা থাকে। নির্বাচন যেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এখানে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যায়। সেটা হলো, সম্প্রতি সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে দুই দল একমত হয়েছে।
আসমা জাহাঙ্গীর পাকিস্তানের সাংসদ নন। তিনি যদি সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হন, তাহলে তিনি হবেন অনির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী। যদি আসমা জাহাঙ্গীর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে রাজি না হন, তাহলে জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ হুসেইন হারুনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার ব্যাপারে দুই দল মতৈক্যে পৌঁছেছে বলে দুই দলের অভ্যন্তরের সূত্রগুলো জানিয়েছে। তিনিও কোনো দলের সদস্য নন।
তাহলে কথাটা দাঁড়াল এই যে পাকিস্তানে অনির্বাচিত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে চলেছে। বাংলাদেশেও অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সাংবিধানিক বিধান ছিল। তখন অনেক জ্ঞানী-গুণী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে বলতে শুনেছি, অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে গণতন্ত্র থাকে না; রাজনৈতিক নেতারা যদি নিজেরা নিজেদের বিশ্বাস না করতে পারেন, তাহলে মানুষ তাঁদের বিশ্বাস করবে কিসের ভিত্তিতে? ইত্যাদি নানা যুক্তি। কিন্তু এবার যেই না সেই তত্ত্বাবধায়ক বিধান আদালতের রায়ে বাতিল করা হলো, অমনি ওই পুরোনো লোকজনই বলতে শুরু করলেন—গেল গেল, গণতন্ত্র গেল, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আর থাকল কী? ইত্যাদি। আগে বলা হতো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের নজির পৃথিবীতে নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানে আছে। শুধু পাকিস্তান কেন, সম্প্রতি গ্রিসে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে তাঁর অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা তাঁদের সংবিধানেই আছে।
আচ্ছা, বাংলাদেশে না হয় বুঝলাম বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, পাকিস্তানে তো বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা আরও প্রকট। এসব দেশে না হয় রাজনীতিবিদেরা নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাস করেন না। কিন্তু গ্রিস? সেখানে কেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা করতে হয়?
আর গ্রিস যদি পারে, পাকিস্তানে যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশে কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারবে না? কেন এখানে তত্ত্বাবধায়কের কথা উঠলেই গণতন্ত্রের কিছু থাকল না বলে কথা ওঠে?
পরিহাসের বিষয় হলো, যে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে এত গণ-আন্দোলন করে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করল, ওরাই এখন সেই বিধান বিলুপ্ত করল। আর যে বিএনপি সেদিন তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে অনমনীয় ছিল, আজ তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তত নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন না করার কথা বলছে।
পাকিস্তানের উদাহরণ যদি না নিই, তাহলে আসুন গ্রিসের উদাহরণ নিই। সেখানেও তো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। তবে যদি গ্রিসের মতো প্রধান বিচারপতির অধীনে নির্বাচন করতে না চাই, না করলাম। একজন নির্দলীয় কাউকে বের করি। সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে তাঁকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান বানাই। তাহলে তো নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংশয় থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এতে সংবিধানে বাধা আছে কি না? এ বিষয়ে আদালতের রায়ের পূর্ণ বিবরণী এখনো প্রকাশ হয়নি। রায়ের পূর্ণ বিবরণী থেকেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা সংবিধানসিদ্ধ হবে কি না। তবে এর আগে যে সংক্ষিপ্ত রায়ের বিবরণী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, রায়ে যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কথা বলা হয়েছে, তা-ও সেখানে একটি সুযোগ রাখা হয়েছে যেন আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব। তবে সেখানে বিচারপতিদের সম্পৃক্ত করা যাবে না। আমাদের দেশের নিজস্ব পরিস্থিতির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই আদালত এ রকম মত দিয়েছেন। যদি রায়ের পূর্ণ বিবরণীতে এ রকম নির্দেশনা থাকে, তাহলে তো নিশ্চয়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে আগামী নির্বাচন হতে পারে। এ জন্য এমনকি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনও হবে না। সংসদ আইনের দ্বারাই এ ব্যবস্থা করতে পারবে।
প্রবাদ বলে, মিয়া-বিবি রাজি, কেয়া করেগা কাজি! সরকারি ও প্রধান বিরোধী দল যদি এসব বিষয়ে একমত হতে পারে, তাহলে সবকিছুই সংবিধানে জায়েজ করে নেওয়া যায়। গণতন্ত্রের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
পাকিস্তানের অনেক কিছুই আমরা বাদ দিয়ে চলি। বিশেষভাবে তাদের রাজনীতিতে বারবার সেনা হস্তক্ষেপের যে ঐতিহ্য, বাংলাদেশের কাছে তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। নব্বইয়ের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান এরশাদের স্বৈরাচারী সেনাশাসন একেবারে আক্ষরিক অর্থে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আর নিকট অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ২০০৭ সালে ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেনা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কীভাবে ছাত্র বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল আসলে ওই ছাত্র অভ্যুত্থানের কারণেই। না হলে হয়তো কোনো পুতুল সরকারের কাঁধে বন্দুক রেখে ‘কার্যত সেনাশাসন’ এখনো চলত।
২০০৭ সালে ‘সেনা-সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নিতে পেরেছিল প্রধানত ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় বিএনপির নানা কূটকৌশলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কুক্ষিগত রাখার অপচেষ্টার কারণে। এখন যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথাকথিত ‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন’ ইত্যাদি যুক্তি দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় পুনরাগমনের স্বপ্ন দেখে, তাহলে ভুল করবে। আবার সেনাশাসনের পথ পরিষ্কার হবে।
পাকিস্তানের পিপিপি ও মুসলিম লিগ-নওয়াজ দল দুটির মধ্যে আদায় কাঁচকলা সম্পর্ক। সম্প্রতি আদালতের রায়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির পদচ্যুতির পর নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফকেও বিদায় নিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, তাঁকেও আদালত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন বলে সবার আশঙ্কা। তাহলে তাঁকেও তো আদালত অবমাননার দায়ে বিদায় নিতে হবে। এতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে। এর সুযোগ সেনাবাহিনী নিতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।
এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট জারদারি এমনও ভাবছেন যে, আগামী মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এ বছরের শেষ দিকেই নির্বাচন দিয়ে দেবেন। এ বিষয়ে আগামী ১৪ আগস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে অগ্রিম নির্বাচনের ঘোষণা আসতে পারে। সরকার আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন দিতে পারে (সূত্র: প্রথম আলো, ১৭ জুলাই, ২০১২)। একদিকে আদালতে নাস্তানাবুদ হয়ে সরকারি দল নিরুপায়, অন্যদিকে সেনা হস্তক্ষেপের আশঙ্কা। এসব কারণে আগাম নির্বাচনের কথা তারা ভাবছে।
বাংলাদেশে কি এ রকম আগাম নির্বাচনের কথা ভাবা যায় না? বাইরের কোনো শক্তির সংবিধানবহির্ভূত হস্তক্ষেপ রোধে প্রয়োজন হলে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ মিটিয়ে ফেলে, অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা দরকার। কোন দল ক্ষমতায় যাবে, সেই চিন্তা না করে, সব দলকে ভাবতে হবে আগামী নির্বাচনে যেন গণতন্ত্র ক্ষমতায় যায়।
এ জন্য যা কিছু করা দরকার, করতে হবে। এমনকি যদি আগাম নির্বাচন করতে হয়, তাতেও কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.