'হঠাৎ' আন্দোলন নিয়ে সন্দেহ শিক্ষামন্ত্রীর-বাইরে থেকে শিক্ষক আনার হুমকি উপাচার্যের

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আগের দিন সোমবার বলেছিলেন, সিনিয়র শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত নিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে বুয়েট পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান করা হবে। এর ঠিক ২৪ ঘণ্টা পরে তিনি গতকাল বললেন, আন্দোলনরত শিক্ষকদের গণপদত্যাগের হুমকির পেছনে 'ভিন্ন উদ্দেশ্য' থাকতে পারে।


শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের কারণে বুয়েটে পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে, উপাচার্য অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম বলেছেন, শিক্ষকরা পদত্যাগ করলে বাইরে থেকে শিক্ষক আনা হবে। তাঁদের দিয়ে বুয়েটের ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া হবে।
এদিকে দুই দিন আগে আবির্ভাব ঘটা উপাচার্যপন্থী সংগঠনটি বুয়েট আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সন্দেহ পোষণ করার পর তাদের কর্মসূচির ইতি টেনেছে। অন্যদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষকরা লাগাতার অবস্থান ধর্মঘটের পরিবর্তে গতকাল থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। এ কর্মসূচি আগামী শনিবার পর্যন্ত চলবে। বুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, 'আমাদের আন্দোলনের ভিন্ন উদ্দেশ্য নেই। আমরা সরকারকে বিপাকে ফেলতে আন্দোলন করছি না।' লাগাতার অবস্থান থেকে সরে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গণতান্ত্রিক সরকারকে সময় দিতেই আমরা কর্মসূচি কমিয়েছি। আশা করছি গণতান্ত্রিক সরকার আগামী রবিবারের মধ্যে আমাদের গণতান্ত্রিক দাবি বাস্তবায়ন করবে।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, সরকার বুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে বহাল রাখার জন্য নানা ফন্দি খুঁজে বেরাচ্ছে। যার নমুনা শিক্ষামন্ত্রী গতকালের বক্তব্যের মাধ্যমেই দিয়েছেন। তিন মাস ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলে আসছেন আলোচনার মাধ্যমে বুয়েট পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চলছে। হঠাৎ তিনি 'আন্দোলনে ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে' বলে কী বোঝাতে চাইছেন? গতকালের শিক্ষামন্ত্রী এবং উপাচার্যের বক্তব্যের ফলে বুয়েটের সংকট আরো ঘনীভূত হয়ে উঠতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : রবিবারের মধ্যে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে অপসারণ না করা হলে শিক্ষকদের একসঙ্গে পদত্যাগের হুমকির পর শিক্ষামন্ত্রী গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সেখানে তিনি বলেন, 'আমার সন্দেহ হচ্ছে সমাধানের নানা উদ্যোগ ব্যাহত করতে তাঁদের হয়তো অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে।' শিক্ষকদের পদত্যাগের হুমকির ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে নাহিদ বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে সভা শেষ করার ৪০ মিনিটের মধ্যে শিক্ষক সমিতি সভা ডেকে গণপদত্যাগের হুমকি দিয়েছে। কৌশলে সভাকে প্রত্যাখ্যান করে তা ভিন্ন খাতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া যাতে এগোতে না পারে, সেজন্য প্রকাশ্যে এই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, 'সোমবার সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের পর ওই দিন রাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা যাই। প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখেই বলেন, 'আলোচনা করে কী করলেন, আপনি আমার কাছে আসার আগেই তো ওরা কর্মসূচি ঘোষণা করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এখন কোন মুখে রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। এই প্রক্রিয়া নিয়ে এগোতে আমরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
নাহিদ বলেন, 'রাষ্ট্রপতি (আচার্য) ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা করে যখন বুয়েট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছি, তখন শিক্ষক সমিতি গণপদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল। এতে আমরা উদ্বিগ্ন। বিষয়টি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজ যেন অনুধাবন করেন। এরপরও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খোঁজা হবে।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, সরকার উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে বাঁচানোর কোনো কৌশল করছে না। বিশ্ববিদ্যালয় চলবে তার নিজস্ব আইনে। এখানে কে উপাচার্য আর উপ-উপাচার্য পদে থাকবেন, আর কে থাকবেন না- সেটা আইনই দেখবে। এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো চলছে কি না তা দেখা। দীর্ঘদিনের আন্দোলনেও কেন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, কেউ বললেই তো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। আইন আছে, পদ্ধতি আছে।
উপাচার্যের সংবাদ সম্মেলন : মঙ্গলবার নিজের বাসায় উপাচার্য অধ্যাপক এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, নিয়মানুযায়ী গণপদত্যাগ হয় না। শিক্ষকদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে না। কেউ পদত্যাগ করছে বললেই বা পদত্যাগপত্র জমা দিলেই পদত্যাগ হয়ে যাবে- ব্যাপারটি তেমন নয়। সিন্ডিকেটই সিদ্ধান্ত নেবে, কার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে, কারটা হবে না। শিক্ষকদের পদত্যাগপত্র সিন্ডিকেট গ্রহণ করলে বাইরে থেকে শিক্ষক আনা হবে। উপাচার্য বলেন, আগে পদত্যাগ করা ২৪ জন শিক্ষকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি। আর এখন শিক্ষকরা পদত্যাগের কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন এবং প্রশাসনকে জিম্মি করছেন।
উপাচার্যপন্থী কর্মসূচি প্রত্যাহার : বুয়েটে চলমান আন্দোলনে উপাচার্যপন্থী 'শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কার্মচারী ঐক্য ফোরাম' তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। গতকাল বিকেলে বুয়েট আন্দোলনের 'পক্ষে-বিপক্ষে' তাদের অবস্থান এবং বিভিন্ন কর্মসূচি প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটোরিয়ার সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন ফোরামের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর ডাকা বৈঠকের পর আমরা জানতে পেরেছি সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আলোচনা চলছে। আমরা আলোচনায় বিশ্বাসী এবং আশা করি আলোচনার মাধ্যমেই এ সঙ্কটের সমাধান হবে।
শিক্ষক সমিতির আন্দোলন চলছে : উপাচার্য, উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবারও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বুয়েটের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা। আগের ঘোষণা অনুযায়ী, সকাল ১১টা থেকে দুই ঘণ্টা বুয়েটের প্রশাসনিক ভবনের সামনে তাঁরা এই কর্মসূচি পালন করেন। সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান অবস্থান কর্মসূচিতে বলেন, এখন সময় এসেছে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগ করার। এর কোনো বিকল্প নেই। উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদত্যাগ করলে বুয়েটে একটি 'ইতিহাস' সৃষ্টি হবে। অন্যায় করে যে বুয়েটে পার পাওয়া যায় না, তার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.