আনোয়ারায় অবৈধভাবে জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার-হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য

বিশ্বের সব দেশই যখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন সরকারের ভেতরের একটি কুচক্রী মহল বেসরকারি খাতে বৃহত্তম তেল শোধনাগার (রিফাইনারি) স্থাপনের একটি প্রকল্প-উদ্যোগকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগে ভবিষ্যতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে


প্রাথমিক সিদ্ধান্তের আগেই কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরির নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে প্রস্তুতি পর্বেই মেরে ফেলা হলো। বিদেশি কম্পানির স্বার্থে দেশীয় শিল্প সম্ভাবনা ধ্বংসের এ ঘটনা নজিরবিহীন এবং সরকারের ঘোষিত নীতির পরিপন্থী বলে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন।
বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি কম্পানি দেশের বৃহত্তম এ তেল শোধনাগার নির্মাণের জন্য চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়া ও মাঝেরচর মৌজায় ২০০৩ ও ২০০৬ সালে তিন ক্যাটাগরির ৩৫৭.৪৫ একর জমি অত্যন্ত স্বচ্ছ পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদি লিজ, শিল্প স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ৫০ বছরের জন্য লিজ গ্রহণ এবং বৈধ মালিকদের কাছ থেকে কিনে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এর উন্নয়ন করেছে। প্রস্তাবিত এ তেল শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার, পরোক্ষভাবে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি বর্তমানে দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের সামান্য অংশই পূরণ করতে পারছে। বসুন্ধরা গ্রুপের প্রস্তাবিত শোধনাগারটি নির্মিত হলে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা হ্রাস এবং স্বল্প মূল্যে অশোধিত তেল আমদানি করে বিভিন্ন গ্রেডের জ্বালানি তেল উৎপাদন করে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হতো। এ ছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং শোধন প্রক্রিয়ায় অনেক ধরনের পেট্রোলিয়াম বাই-প্রডাক্ট (উপজাত) উৎপাদনও করা যেত। বর্তমানে এসব বাই-প্রডাক্ট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।
বসুন্ধরা গ্রুপ আলোচ্য জমির জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বার্ষিক প্রায় ৮.৪৫ কোটি টাকা হারে লিজ ভাড়া পরিশোধ ছাড়াও সরকারের কোষাগারে বার্ষিক প্রায় ২.১৫ কোটি টাকা ভ্যাট ও উৎসে কর পরিশোধ করছে। সরকারের অনুমোদনক্রমে এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের লিজ দলিলের শর্ত অনুযায়ী শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন, সীমানা বাঁধ নির্মাণ, নদীকূলের ভাঙন রোধের স্থায়ী ব্যবস্থাকরণ, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, আনসার-প্রহরীর বেতন-ভাতা, প্রকল্প কার্যালয় স্থাপন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভূমি উন্নয়নের জন্য দেশের বৃহত্তম দুটি ড্রেজার ক্রয়সহ আনুষঙ্গিক খাতে প্রায় ৫৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ফলে এখানে কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্ট গার্ডের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা, সর্বস্তরের জনসাধারণ, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আপত্তি ও বিরোধিতা করে চলেছেন। এ ছাড়া বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবার আপত্তি সত্ত্বেও কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা ডাম্পিং ইয়ার্ড স্থাপনে জনস্বার্থ রক্ষিত হবে না বলে স্থানীয় জনগণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়া ও মাঝেরচর মৌজায় ৮৪.৫৫ একর জমি পূর্বের লিজগ্রহীতাদের আবেদনের ভিত্তিতে সরকারের অনুমোদনক্রমে বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের বরাবরে ২০০৩ সালে দুটি দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়। পরে সরকারের অনুমোদনক্রমে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ২০০৬ সালে সম্পাদিত দলিলের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি লিজ নবায়ন করা হয়। কৃষিভূমির জন্য আগের প্রতি শতকে ১.২৫ টাকার স্থলে শিল্পভূমির জন্য শতকপ্রতি ১২৫ টাকা হারে ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) পরিশোধ করা হচ্ছে। রাঙ্গাদিয়া মৌজার ৬.৯০ একর জমি বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লি. রেকর্ডভুক্ত মালিক মো. শাহাদত হোসেন চৌধুরীর কাছ থেকে ভোগদখলে থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালের ৪ জুন ক্রয় করা হয়েছে। আর আনোয়ারা উপজেলাধীন কর্ণফুলী নদী-তীরবর্তী মাঝেরচর মৌজার ২৬৪ একর জমির রেকর্ডকৃত মূল মালিক হিসেবে ভোগদখলরত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অব্যবহৃত ওই জমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করলে বসুন্ধরা গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লি. অন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠিত কম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়ে ৫০ বছরের জন্য লিজ লাভ করে। ২০০৬ সালের ২২ আগস্ট বন্দর কর্তৃপক্ষ ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টিকে এ ভূমি হস্তান্তর করে।
অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, আলোচ্য এ ৩৫৭.৪৫ একর জমি সরকারের ১ নং খতিয়ানের খাসজমি না হওয়া সত্ত্বেও সরকারের একটি স্বার্থান্বেষী মহল একে খাসজমি বলে প্রচার করেছে। অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণ মামলা (এলএ কেস)-১/২০১০-২০১১-এর আওতায় এসব ভূমিকে সরকারের ১ নং খতিয়ানের সম্পত্তি দেখিয়ে অধিগ্রহণের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। অথচ গত ২২ মে এবং ৫ জুলাই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) যে জমি হস্তান্তর করা হয়েছে তা বন্দর কর্তৃপক্ষের নামে ২ নং, বসুন্ধরা গ্রুপের নামের ১৭৬, ৪৫ এবং ১৮৭ নং খতিয়ানের সম্পত্তি। ফলে এসব ভূমির দখল ও হস্তান্তর সঠিক, ন্যায্য আইনসঙ্গত না হওয়ায় বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয় ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লি: এবং বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের যে জমি অধিগ্রহণ করেনি- এমন জমিও প্রত্যাশী সংস্থা পিডিবিকে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাষ্ট্র কোনো জমি অধিগ্রহণ করলে তা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার মাধ্যমে করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি, যা নজিরবিহীন ঘটনা।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১৪ নভেম্বর লিখিতভাবে আলোচ্য ভূমির বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়কে নতুন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রতিবেদন দাখিলের আগেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে উপেক্ষা করে ভূমি মন্ত্রণালয় আলোচ্য ভূমি সরাসরি অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে বলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে অবহিত করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি কম্পানির পক্ষ থেকে এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হলে তিনি আলোচ্য ভূমিকে তেল শোধনাগার স্থাপনের জন্য অধিগ্রহণবহির্ভূত রাখা হবে বলে মৌখিকভাবে জানান। জ্বালানি উপদেষ্টা এবং তৎকালীন মুখ্য সচিবকে এ বিষয়ে তিনি নির্দেশনা দেন। পরে গত ফেব্রুয়ারিতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে আবারও সাক্ষাৎ করা হলে প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও মুখ্য সচিবকে তেল শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের এবং এ জমি অধিগ্রহণ না করার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবহিতকরণ ও বাস্তবায়নের আদেশ দেন।
এর আগে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় গঠিত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে আনোয়ারা উপজেলার আলোচ্য এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে আনোয়ারার পরিবর্তে বাঁশখালীর খানখানাবাদ মৌজায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এ অবস্থায় কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড স্থাপনের জন্য আনোয়ারা মৌজায় জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্তকে সংশ্লিষ্ট মহল জনস্বার্থের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে।
এ ছাড়া ওই এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ভূ-সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হয়নি বা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করে বা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কোনো প্রস্তুতি তথা জমি অধিগ্রহণ না করে কেবল ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য জমি দখল অধিগ্রহণ আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, এর সঙ্গে জনস্বার্থ জড়িত নেই। তাই জনস্বার্থবিরোধী জমি অধিগ্রহণ অযৌক্তিক বলেই এলাকাবাসী এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
এদিকে ভূমি অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, ভুল ও অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়ায় এ বিষয়ে রিট পিটিশন দায়ের করা হলে উচ্চ আদালত রুলনিশি জারি করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। চেম্বার জজের মাধ্যমে স্থিতাবস্থা স্থগিত করা হলেও মূল মামলা শুনানির জন্য দৈনিক কার্যতালিকার শীর্ষে রয়েছে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর এ বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। এ অবস্থায় বিচারাধীন সম্পত্তি দখলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতি দ্রুত পদক্ষেপকে অভিজ্ঞ মহল আদালত অবমাননার শামিল বলেও মনে করছে। এ ছাড়া অস্বচ্ছ, বিভ্রান্তিকর, শঠতার আশ্রয় নিয়ে অধিগ্রহণ-প্রক্রিয়ায় ৩ ধারা নোটিশসহ অন্যান্য বিষয়ে উচ্চ আদালতে আরেকটি রিট মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বী বিবাদী করা হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি আবেদনের মাধ্যমে অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ রিট মামলায়ও সম্প্রতি রুল জারি হয়েছে। অথচ অধিগ্রহণকারী জেলা প্রশাসন উচ্চ আদালতের রুল অমান্য করে ভূমি দখল করে পিডিবিকে হস্তান্তর করেছে।
নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই খননকাজ শুরু
ডিসির ভাষ্য, লেখেন আমি নেই

No comments

Powered by Blogger.