খাল না কেটেও... by আসিফ আহমেদ

বাংলা ভাষায় 'খাল কেটে কুমির আনা' প্রবাদ রয়েছে। কিন্তু মেঘনা তীরের ভোলা জেলার সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর গ্রামের আমিনুল্যার বাড়ির সামনের পুকুরে একটি কুমির এসেছে বৈরী প্রকৃতির রোষের কারণে। পুকুরটির দক্ষিণে প্রায় ১০০ মিটার দূরে ইলিশা নদী। উত্তরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে মেঘনা।


কুমির পানিতে থাকে। ডাঙায় চলতে তার অসুবিধা নেই। নদী থেকে হেঁটে এ পুকুরে সে আসতেই পারে। তবে একটি সূত্র মেলে বৈকি। গত বছরের অক্টোবরে অস্বাভাবিক বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলে রামদাসপুর গ্রামটিও তার শিকার হয়। বঙ্গোপসাগর থেকে নদী হয়ে কুমিরটি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই হয়তো ভেসে চলে আসে পুকুরে। কিংবা ভেসে বেড়ানোর আনন্দে মেতেই সে নিজেকে দেখতে পায় বদ্ধ পুকুরে। তাতে তেমন সমস্যা হয়নি। পুকুরে প্রচুর মাছ ছিল। এ জন্য কোনো ভাগীদারও ছিল না। একাই সব মাছ সাবাড় করে চলছিল। মাঝে মধ্যে রুচি বদলাতে পাশের বাড়িতে হানা দিয়ে হাঁস-মুরগি সাবাড় করত। এ কাজ করতে রাতের অন্ধকারকেই কুমিরটি বেছে নিচ্ছিল। নিঃশব্দেই চলত অভিযান। বাড়ির মহিলারা হয়তো শাপান্ত করেছেন অদৃশ্য চোরকে। এ কারণে বলতে হয়, কুমিরটি বেশ বুদ্ধিমান। শিয়ালের কাছে ছানাদের পড়াতে দেওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতা করেছিল একটি কুমির। এ কুমিরটি নিশ্চিতভাবেই সেটা করত না। যে পুকুরে আস্তানা গেড়েছিল, সেখানে রাতের বেলায় সে দাপিয়ে বেড়াত। মালিক তার ধোঁকা খেয়েছে। তিনি মনে করতেন, তার চাষের রুই-কাতলা বেশ বড় হয়ে উঠছে। জলোচ্ছ্বাসের সময় আশপাশের সব এলাকার পুকুরের মাছ ভেসে চলে যায় নদী ও সাগরে। এসব মাছের কিছু নিশ্চয়ই তার পুকুরেও এসেছে। এ মৌসুমে ভালো লাভ হবে ভেবে হয়তো আনন্দেই ছিলেন। কিন্তু কুমির ধরতে গিয়ে পুকুরে জাল ফেলে দেখা গেল, সব সাবাড় হয়ে গেছে।
বুদ্ধিমান কুমিরটি ৯ মাস ধরে রাতেই অভিযান চালিয়ে এসেছে। কেউ তার অস্তিত্ব টের পায়নি। অতঃপর সে কি দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিল? নাকি পুকুরের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি চাইছিল বলে নিজের উপস্থিতি জানাতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল? নইলে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাতে কেন পুকুর পাড়ে অবস্থান নেবে?
কুমিরটি শুধু বুদ্ধিমান নয়, বলতে হবে ভাগ্যবানও। তাকে জাল দিয়ে ধরা হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসী পিটিয়ে তাকে হত্যা করেনি। চার মাস আগে এই রামদাসপুরের কাছেই কানাবগির চরের এক পুকুরে বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা একটি কুমির ধরা পড়েছিল। কিন্তু সেটিকে মেরে ফেলা হয়। এর সূত্র ধরে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই মামলার আসামিদের হেনস্তা করতে পুলিশ বলতেই পারে :'কুমির মেরেছে যে, আমাদের খুশি না করলে জেলে যাবে সে।' এ অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো আমিনুল্যার বাড়ির কাছে ধরা পড়া কুমিরটি প্রাণে বেঁচে গেছে। এলাকার জওয়ান পুরুষরা বিক্রম দেখিয়ে কুমিরটি ধরলেও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্থানীয় বন বিভাগের তৎপরতাও প্রশংসনীয়। তারা জানিয়ে দেয়, কুমির ধরতে যা খরচা হবে সেটা তারা দেবে। কুমির যে মাছ এবং হাঁস-মুরগি খেয়েছে তারও ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হবে।
এখন কুমিরটির স্থান হবে সাফারি পার্ক কিংবা চিড়িয়াখানায়। তাতে তো মুক্তি মিলবে না। বরং শৃঙ্খলার বেড়ি আরও শক্ত হবে। নতুন আবাসস্থলে রুটিনমতো খাবার মিলবে। রোদ পোহাতেও মিলবে এক চিলতে জমি। কিন্তু সবকিছুর পরও তো এটা খাঁচা_ সেখানে সাঁতার কাটার সুযোগ যে নেই।
 

No comments

Powered by Blogger.