বাজেট-পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ বরাদ্দ চাই by অভয় প্রকাশ চাকমা

রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। ফলে পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনীতিও ব্যতিক্রম। তাই অনেক সময় সরকারিভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত পার্বত্য অঞ্চলে সফলভাবে কার্যকর করা যায় না।


ফলে পাস হওয়া বাজেটের ইতিবাচক দিকগুলো এখানে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না


আগামী মাসে বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমান সরকারের এটি হবে তৃতীয় বাজেট। কৃষি, শিক্ষা, এনার্জি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট তৈরি হচ্ছে। গত বছরগুলোতে কৃষি খাতে বর্ধিত ভর্তুকিতে সফলতা দৃশ্যমান হয়েছে। এবারের বাজেটেও কৃষিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা যায়। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। ফলে পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনীতিও ব্যতিক্রম। তাই অনেক সময় সরকারিভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত পার্বত্য অঞ্চলে সফলভাবে কার্যকর করা যায় না। ফলে পাস হওয়া বাজেটের ইতিবাচক দিকগুলো এখানে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই প্রণীতব্য বাজেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটু ভিন্নদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিপুল সম্ভাবনাময় অঞ্চল। এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন। সঠিক পরিকল্পনা করা গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রচুর অবদান রাখতে পারবে এই অঞ্চল। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনার অভাবে এখানকার অর্থনীতির অবস্থা পঙ্গু, আর এই পঙ্গুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রচুর বনজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলে মান্ধাতা আমলের কর্ণফুলী কাগজের কল ও একটি পল্গাইউড ফ্যাক্টরি ছাড়া বনসম্পদভিত্তিক কোনো শিল্প বা ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠেনি। প্রচুর ফলমূল উৎপন্ন হলেও নেই কোনো ফলের ফ্যাক্টরি। কোনো গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি না থাকায় এখানকার হাজার হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন সত্ত্বেও ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে চাকরি করছে। এখানে নেই কোনো বিনিয়োগ, নেই গ্যাসলাইন। দেশের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও পার্বত্য অঞ্চলের অধিকাংশ রয়েছে বিদ্যুৎহীন। অথচ এই বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কারণে ১৯৬১ সালে বিশ হাজার আদিবাসী পরিবারের ৫৪ হাজার একর ধানি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাসলাইন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আর গ্যাসক্ষেত্রের নিকটবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনও রয়েছে গ্যাসহীন।
পার্বত্য অঞ্চলের বিপুল সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার। নিম্নবর্ণিত সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিশেষ বরাদ্দ রাখার বিবেচনা করা যেতে পারে।
বনায়ন : পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা বনোপযোগী। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া কাঠ, বাঁশ ও বেতের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অর্থায়নের অভাবে এখানে বন বাগান গড়ে উঠছে না। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বনায়ন করা গেলে সারাদেশের কাঠ বা কাঠজাত পণ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বেসরকারি পর্যায়ে বনায়নের জন্য কৃষি ঋণের মতো বনচাষিদের জন্যও পৃথক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিকটস্থ গ্রামবাসীদের সম্পৃক্ত করে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ব্যাপক বনায়ন করা যায়। এতে কার্বন মিটিগেট হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতও কমানো যাবে। এ জন্য আসন্ন বাজেটে এ খাতে প্রচুর বরাদ্দ রাখা সমীচীন।
ফলবাগান : ফলবাগানের জন্যও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্ভাবনাময়। এখানে প্রচুর কাঁঠাল, আনারস, আম, লিচু, পেয়ারা, পেঁপে, কলা, তরমুজের ফলন হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানকার উৎপাদিত ফল দিয়ে সারাদেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাই বাজেটে ফলচাষিদের জন্যও ভর্তুকিসহ বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।
রাবার ও চা বাগান : প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অর্থায়নের অভাবে এখানে চা ও রাবার বাগান গড়ে উঠছে না। ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু রাবার চাষ হলেও আশানুরূপ নয়। সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া গেলে এখানে ব্যাপক চা ও রাবার বাগান গড়ে তোলা সম্ভব।
শিল্প-কারখানা : এখানে কাঠ, বাঁশ ও বেতনির্ভর অনেক ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা সম্ভব। অফসেট পেপার, নিউজ পেপার, হোয়াইট পেপার, টিস্যু পেপার, কার্টন পেপার, পল্গাইউড, হার্ডবোর্ড, টুথপিক, ম্যাচ ফ্যাক্টরি ইত্যাদি নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনের জন্য ছোট-বড় অনেক ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা যায়। চা ও রাবার বাগান গড়ে তুললে চা ও রাবার ফ্যাক্টরিও স্থাপন করতে হবে। ফলমূল সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ, ফ্রুটস ফ্যাক্টরি ইত্যাদি স্থাপনে আর্থিক সহায়তার জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। ইপিজেড, গার্মেন্টসহ বিশেষ শিল্প এলাকা গড়ে শিল্প-কারখানা স্থাপন করা যায়।
পর্যটন : প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-শোভিত পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের জন্য খুবই উপযোগী। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষত রেখে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর্ণফুলী হ্রদকে কাজে লাগানো গেলে পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে রাঙামাটি।
ভৌত অবকাঠামো : পার্বত্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অন্য জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ উন্নত করার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে পর্যটন শিল্পও বিকশিত হবে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস : পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ইউনিয়ন পর্যায়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্প এলাকা গড়ে তুলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। খাগড়াছড়ির সেমুতাংয়ের গ্যাস পার্বত্য জেলায় সরবরাহ নিশ্চিত করে প্রতিটি জেলায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য : উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় আদিবাসীদের সম্প্রদায়ভিত্তিক মাতৃভাষা সংযুক্ত করতে হবে। এই এলাকার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। মানদণ্ড বিচার করে বেশিসংখ্যক স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্ত করতে হবে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রতিবছর ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক লোক মারা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা, তাই ম্যালেরিয়া নির্মূলের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি : তথ্যপ্রযুক্তিতে পার্বত্য অঞ্চল অনেক পিছিয়ে রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষা দিতে হবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ কম্পিউটার সরবরাহ ও শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখা দরকার। দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেলফোন সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছে, এখনও অনেক এলাকায় নেটওয়ার্ক দেওয়া হয়নি। সারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেলফোন নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
জুম, পশুপালন ও মৎস্য চাষ : জুম চাষকে কৃষিঋণের আওতায় আনা হয়নি। জুম চাষে প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা থাকলে ধান-সবজির ব্যাপক ফলন হবে এবং আদা, হলুদ, মরিচ ইত্যাদি মসলাজাতীয় শস্যে সারাদেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব। শূকর, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, ব্যাঙ, কুচেসহ বিভিন্ন মাছ চাষে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকলে আদিবাসীদের খাদ্যঘাটতি থাকবে না।
জাতীয়ভাবে বাজেট পাস হলেও এর প্রতিফলন হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে কম। পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য উলি্লখিত খাতগুলোতে বরাদ্দ রাখা খুবই জরুরি। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার সার্বিক উন্নয়নের সুযোগ এসেছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে দৃষ্টি না দিলে এই এলাকার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্য এবং শান্তি বজায় রাখা যাবে না। স্থায়ী শান্তির স্বার্থে আগামী বাজেটে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে সরকার বিবেচনা করবে কি?

অভয় প্রকাশ চাকমা : কলাম লেখক
abhoychakma@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.