চারদিক-কারও দয়ায় পাওয়া নয়

রাজশাহীর নার্গিস আক্তার শরীফা, বগুড়ার ফেরদৌসী আরা লাকী ও হাসি খাতুন এখন ঢাকায়। এই তিন প্রতিবন্ধী নারীর এবারের ঢাকায় আসার গল্পটা একটু অন্য রকম। আজ বুধবার এই তিনজনই সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মাননা পাবেন।


সম্মাননাটি দিচ্ছে বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। আজ বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে তাঁদের এ সম্মাননা জানাতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাসসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার কথা। সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তা শরীফা পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা পদক ও সনদ। লাকী আর হাসি প্রত্যেকে পাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা, পদক ও সনদ।
এই তিনজন আজ যে সম্মাননা পাবেন, তা কারও দয়ায় পাচ্ছেন না। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সফল প্রতিবন্ধী নারী উদ্যোক্তাদের খোঁজ শুরু হয়। সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে দুটি আলাদা প্যানেলে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে তাঁরা আজ বিজয়ী।
শৈশবে মা ছাড়া আর কেউ ভালোবাসেননি শরীফাকে। দুই হাঁটু দিয়ে হাঁটেন তিনি। এই মেয়ের লেখাপড়ার জন্য বই-খাতা কেনার কথা তাঁর মা সাহস করে বাবাকে বলতেই পারেননি। ঘরে মাটিতে বসে বসেই কাঠি দিয়ে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লেখা শেখা। বাবার চোখের আড়ালে রাখতে মা শরীফাকে একটি হিন্দু পরিবারে সারা দিনের জন্য রেখে আসতেন, আর রাতে বাড়ি নিয়ে আসতেন। সে বাড়িতেই পদ্মমুণি হস্ত কুটিরশিল্পের কাজ দেখে শরীফাও তা শিখে ফেলেন। এই শেখা কাজ থেকে যা আয়, তা দিয়েই শরীফার স্কুলের পড়াশোনা শুরু।
১৯৯৮ সালে এসএসসি পাস করার পর বাবা এই প্রতিবন্ধী মেয়েকে একটু একটু ভালোবাসতে শুরু করেন। সেই বাবাও মারা গেলে বন্ধ হয়ে যায় শরীফার কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন। ২০০০ সালে মারা গেলেন মা। একা সংগ্রাম করে বাঁচতে শরীফা সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ঋণ নেন পাঁচ হাজার টাকা। এ সময় পরিচয় হয় বর্তমান জীবনসঙ্গী আবদুর রহিমের সঙ্গে। মাত্র দুই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০৬ সালে শুরু করে শরীফার এল এস কেমিক্যাল কোম্পানি। সরকারি অনুমোদনও পান। তবে কাজটা সহজ ছিল না। ঋণ নিতে গেলে ২০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা। হাঁটু দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ব্যাংকের ওপর তলায় ওঠানামা করতে করতে দুই পায়ের হাঁটুতে ফোসকা পড়া, ব্যাংকের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে করতে গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার কথা ভোলেননি শরীফা। ট্রেড লাইসেন্স করতে গেলে অফিসের সামনে এক ভদ্রলোক ভিখারি মনে করে সাহায্য দিতে চান, যে কষ্টের কথা শরীফা কোনো দিনও ভুলবেন না। এরপর রান্না করতে গিয়ে ২০০৯ সালে গায়ে আগুন লেগে সারা শরীর পুড়ে যায় তাঁর। বাঁ হাতটি অকেজো হয়ে যায়। তার পরও থামেননি শরীফা। বর্তমানে শরীফার কোম্পানিতে প্রত্যক্ষভাবেই পাঁচজন প্রতিবন্ধীসহ ২০ জন কাজ করছেন। উপটান, লোশন, নেইল পলিশ ইত্যাদি তৈরি করে কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১২ লাখ টাকা। শরিফা প্রতিটি পণ্যের বিক্রয়মূল্য থেকে এক টাকা প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে ব্যয় করার জন্য জমা রাখেন।
দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবা-মা পিকআপ চালকের সঙ্গে লাকীর বিয়ে দেন। নেশা করা স্বামী যৌতুকের জন্য লাকীকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন। এতে মেরুদণ্ড ভেঙে লাকী হয়ে যান প্রতিবন্ধী। লাকী বগুড়ার আটাপাড়া আন্দোলন প্রতিবন্ধী অধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। বগুড়া অন্ধ সংস্থার সভাপতি মীর মোরশেদ আলীর সহযোগিতায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এসএসসি পাস করেন। চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেন লাকী। ২০০৩ সালেই মায়ের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে কাগজের ঠোঙা তৈরি শুরু করেন। এডিডির সহযোগিতায় ঋণের টাকা দিয়ে বর্তমানে ঠোঙার ব্যবসা থেকে লাকীর মাসে নিট আয় ১৭ হাজার টাকা। তিনজন প্রতিবন্ধীসহ ১৫ জনের কর্মসংস্থানও হয়েছে। লায়ন্স ক্লাব থেকে পাওয়া একটি সেলাই মেশিন দিয়ে লাকী ২০ জন দুস্থ, বেকার ও প্রতিবন্ধী নারীকে বিনা মূল্যে ব্লক, বাটিক, কারচুপি ও সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
৪২ বছর বয়সী হাসি খাতুনও বগুড়ার মেয়ে। ১৯৮২ সালে হাসির বিয়ে হয়। ছেলের মা হন; কিন্তু নির্যাতন পিছু ছাড়েনি। বাধ্য হয়ে ১৪ মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে ১৯৮৫ সালে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসার জন্য রেলস্টেশনে আসেন। শ্বশুর তাঁর পালানোর কথা জেনে যান। হাসি দ্রুত চলন্ত ট্রেনে উঠতে গেলে শ্বশুর নাতিকে ধরে টান দেন এবং হাসির দুই পা চলে যায় ট্রেনের চাকার নিচে। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার হাসি হয়ে যান ৩৪ ইঞ্চি। বাবার রেখে যাওয়া জমিতে একটি ছোট ঘরে বয়স্ক প্রতিবন্ধী ও অসহায়দের সেলাই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। চলতি বছর ‘ভাই-বোন টেইলার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন হাসি। এখানে ১৫ জন বেকার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন প্রতিবন্ধী। মাসে আয় হয় ছয় হাজার ৩০০ টাকা।
অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট মোল্লা বলেন, এ উদ্যোগ হবে প্রতিবন্ধী ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার প্রসার ঘটাতে এক মাইলফলক।
মানসুরা হোসাইন

No comments

Powered by Blogger.