পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিল বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য-সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার বিষয়টি অসম্ভব নয়

পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিলের পর বিশ্বব্যাংকের সেই পদক্ষেপ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এ নিয়ে শুরু হয় নানা বিতর্ক। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক গতকাল ই-মেইলের মাধ্যমে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।


বিশ্বব্যাংক কি তদন্তের ফল সরকারকে জানিয়েছে?
আমাদের নিজস্ব নীতি অনুসারে বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দুটি তদন্তের তথ্য-প্রমাণ প্রদান করেছে। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টির পুনর্তদন্ত করতে এবং যথাযথ বিবেচিত হলে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম।
সরকারের কাছে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া রেফারেল রিপোর্টে কী ছিল?
সরকারের কাছে সুপারিশমূলক রিপোর্ট প্রদানের লক্ষ্য ছিল যথাযথ জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ সম্পর্কে একটি জোরালো তদন্ত শুরু করা। বিশ্বব্যাংকের স্বাধীন ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্টসি দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে দেখে যে, ব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী দিকনির্দেশনা লঙ্ঘিত হয়েছে কি না এবং জাতীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করার জন্য যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে কি না। বিশ্বব্যাংক নিজে কোনো অপরাধ তদন্ত করে না বা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করে না। এটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিবেচ্য।

বিশ্বব্যাংক সরকারকে দেওয়া এই রিপোর্টগুলো কেন প্রকাশ করছে না?
বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেশ করেছে। এসব সুপারিশমূলক রিপোর্টের গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারসহ প্রত্যেক সদস্য দেশের কাছে বিশ্বব্যাংকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে, বাংলাদেশ সরকার এসব রিপোর্ট ও চিঠি চাইলে প্রকাশ করতে পারে। আপনারা সরকারকে স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে তা প্রকাশের জন্য অনুরোধ করতে পারেন।

বিশ্বব্যাংক কী কী প্রস্তাব দিয়েছিল? সরকার এর কোনটিতে সম্মত হয়েছিল?
বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছিল, সরকার চারটি পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু সরকার চারটির মধ্যে দুটি করতে পারেনি। প্রথমত, দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি বিশেষ যৌথ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যাতে দুদক সম্মতি দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সরকার একটি বিকল্প প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছিল, যেখানে সহযোগী অর্থায়নকারীদের জন্য ক্রয়-প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির সুযোগ ছিল। তৃতীয়ত, দুদককে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেওয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত দুদক বাইরের প্যানেলের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করার কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রাখার বিষয়টি মেনে নেয়নি। শেষে সরকার বাংলাদেশি আইনের আওতায় থাকা সত্ত্বেও তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তিবর্গকে (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটি দিতে রাজি হয়নি। চারটি ব্যবস্থার মধ্যে দুটি বিষয়ে ঐক্যত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাংকের সেতুর জন্য সহায়তা বাতিল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবগুলো কি বাংলাদেশের আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
বিশ্বব্যাংকের অনুরোধকৃত সব পদক্ষেপ এবং দুর্নীতির অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশি আইন, রীতিনীতি ও বিধি-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কোথাও কোথাও সরকারি কর্মকর্তাদের বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রাক-যোগ্যতা বাছাইয়ের সময় বিশ্বব্যাংক একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে পক্ষপাত করায় সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যার ফলে প্রকল্পটি বাতিল হয়।
এটি একেবারেই সত্য নয়। বিশ্বব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠানকেই বিশেষ আনুকূল্য প্রদর্শন করে না। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আমরা যখন ক্রয়-প্রক্রিয়া তদারকি করি, তখন সরকারের দায়িত্ব থাকে প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময় সেটি সক্ষম কি না আর কারা সক্ষম না তা মূল্যায়নের ন্যায্যতা প্রদান করা। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর মতো বিলিয়ন ডলার ছড়িয়ে যাওয়া প্রকল্পের ক্ষেত্রে, প্রতিটি ফার্ম বিড করার যোগ্য কি না অথবা তাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাব রয়েছে কি না সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় ব্যাখ্যা প্রদান করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সেতু বিভাগ চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশনকে যথেষ্ট তথ্যাদি ছাড়াই প্রাক-যোগ্যতা থেকে বাদ দিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক বাদ দেওয়ার জন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে আরো তথ্য চাইতে ও প্রয়োজনীয় যথার্থতা প্রদানের অনুরোধ করে। যখন এই তথ্য দেওয়া হয়েছে, তখন বিশ্বব্যাংক এই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিতে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের কোনো দ্বিমত নেই এবং বিশ্বব্যাংক বরাবরই নিরপেক্ষ থেকেছে।

বিশ্বব্যাংক কেন চুক্তি কার্যকর হওয়ার মেয়াদ এক মাস বাকি থাকতেই প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিল?
বিশ্বব্যাংক প্রায় এক বছর ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতির প্রমাণকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। দুঃখজনক যে সরকার প্রায় ৯ মাসেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা এবং জনজীবনে এর গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটি বাঁচাতে শেষপর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক একটি উপায় বের করার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের দল পাঠিয়েছিল। কয়েক দিনের আলোচনার পর, চারটি প্রস্তাবের দুটির ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে কিছু করা সম্ভব নয় জানানোর পর বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিলের কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য হয়।

উচ্চ পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্টের শেষ কার্যদিবসে বাতিল হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংকের দেওয়া বিবৃতিটি প্রতিষ্ঠানের নয় বরং তাঁর ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন।
বিশ্বব্যাংকের সব সিদ্ধান্তই প্রাতিষ্ঠানিক, কোনোটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এটি বিশ্বব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল, কারো একক সিদ্ধান্ত নয়। সরকারের দুর্নীতি মোকাবিলা করার সদিচ্ছার অভাব এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য যেমন দুঃখজনক তেমনি দুঃখজনক বিশ্বব্যাংকের জন্যও। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের দীর্ঘ সম্পর্কের আঙ্গিকে যে অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের প্রায় জন্মের পর থেকেই তা চলমান। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সম্পৃক্ত না থাকা বিশ্বব্যাংকের জন্যও সমান দুঃখজনক।

বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রদেয় ঋণের সুদ কত?
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের অঙ্গসংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (আইডিএ) থেকে সুদমুক্ত ঋণ গ্রহণ করে। প্রাপ্ত সুদমুক্ত ঋণের মেয়াদ ১০ বছরের রেয়াতসহ ৪০ বছর এবং সার্ভিস চার্জ ০.৭৫% প্রযোজ্য। ১১তম থেকে ২০তম বছরের মধ্যে প্রতিবছর ঋণের শতকরা ২ ভাগ শোধ করতে হয়। বাকি ২০ বছরে প্রতিবছর আসলের শতকরা ৪ ভাগ শোধ করতে হয়।

একই ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশকে কি অন্য দেশ থেকে ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে?
না। এ ধরনের ঘটনা অন্য কোনো দেশে হলেও একই ধরনের পরিণাম হতো।

প্রকল্প বাতিল কি বিশ্বব্যাংকের চলমান কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে?
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ব্যাপক কর্মসূচির ওপর কোনো সরাসরি প্রভাব রাখবে না এবং বাংলাদেশের সরকার ও স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে জনজীবনের উন্নয়নে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করব। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৩০টির বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাংক গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন, সামাজিক কল্যাণ সাধন এবং দারিদ্র্য বিমোচন খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পেরে খুবই গর্বিত। আমাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা তৈরি পোশাক শিল্প খাতে সর্বাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রপ্তানি বাজার উদারীকরণ, দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে পাঠানো নিশ্চিত করার জন্য বৃত্তি প্রদান এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবন ও জীবিকায় পরিবর্তন ঘটাতে গ্রামগুলোতে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করতে অবদান রেখেছে। গত অর্থবছর বিশ্বব্যাংক ৮৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ সাহায্য করেছে।

বাতিল সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো অবকাশ কি আছে?
অন্যান্য দেশে বাতিলকৃত ঋণ পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মাত্র কয়েকটি নজির রয়েছে। তাই, এটি অসম্ভব নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার খুব সীমিত সুযোগ রয়েছে। কারণ, প্রস্তাবিত চারটির মধ্যে দুটি পদক্ষেপে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির প্রমাণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পরও সরকার ইতিবাচক সাড়া দিতে পারেনি।
এটি দুঃখজনক ঘটনা। এ সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও সারা দেশের প্রবৃদ্ধি জোরদার এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের জন্য বিশেষ সম্ভাবনাময় ছিল। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে, দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে এবং সুশাসনের ভিত্তির একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ।

No comments

Powered by Blogger.