অল্পবিদ্যা-টক শো: বড়ুয়া-তত্ত্ব by আসিফ নজরুল

টেলিভিশনে টক শো করে নানান অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। রাস্তায় হাঁটলে থামতে হয়, সালামের উত্তর নিতে হয়, হাত মেলাতে হয়। এগুলো ঠিক আছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন কেউ চেপে ধরা হাত আর ছাড়তে চান না। গোয়েন্দাদের গলায় বলেন, আপনেরে চিনা চিনা লাগে! এর উত্তর কী হবে, বুঝতে না পেরে বোকার মতো হাসি।


তিনি বলেন, টক শোতে দেখছি, ঠিক না? জি! কথা তো ভালোই বলেন! আবারও বলি, জি। তিনি আড্ডার মুডে বলেন, এখন বলেন তো দেশের অবস্থা কী বুঝতেছেন!
ভরদুপুরে মহাব্যস্ত ফুটপাতে দেশের অবস্থা বোঝানোর উদ্যম থাকে না। অনুনয় করে বলি, এখন যাই ভাই! তিনি যেতে দেন, তার আগে ফোন নম্বর বিনিময় করেন, একটু উঁকি দিয়ে বোধহয় দেখার চেষ্টা করেন তাঁর নম্বর সেভ করেছি কি না! গভীর রাতে ফোন করেন, আজকে কোন চ্যানেল, ভাই?
টক শো নিয়ে আসল বিড়ম্বনা ঘটে স্টুডিওতে। কখনো দেখি টক শোর হোস্টের মুখ চুপসে আছে। কী ব্যাপার? তিনি জানান, সরকার খুব খেপে আছে, একটু যেন সাবধানে বলি। সরকার খেপে আছে তা বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্ধেক মন্ত্রীও টক শোর সমালোচনা করেন। কিন্তু যেটা বুঝতে পারি না পুরোপুরি, তা হলো, কেন তাঁরা খেপে আছেন? ওয়ান-ইলেভেনের সময় নুরুল কবির আর আসাফউদ্দৌলাহ্ প্রথম থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে লড়ে গেছেন। মাস তিনেক পর স্বপ্নভঙ্গ হলে আমরাও অনেকে যোগ দিয়েছি তাঁদের সঙ্গে। এর আগে বিএনপির সময় আমরা বহুবার তখনকার দুর্নীতি আর সন্ত্রাসের কঠোর সমালোচনা করেছি।
এখন তাহলে টক শোর সমস্যা কী? টক শোতে ভুলটা কি বলি আমরা? আমার এই পুঞ্জীভূত প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে। সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন আমার অনুজপ্রতিম। এক রাতে কম্পিউটারে কাজ করতে করতে তাঁর টক শোতে দিলীপ বড়ুয়ার কণ্ঠ শুনি। তাঁকে তাঁর পেশা কী, জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, সেই অর্থে তাঁর কোনো পেশা নেই। আমাদের টক শো হোস্টদের জনি কার্সন, স্টিফেন সাকা বা ডেভিড ফ্রস্টের মতো স্বাধীনতা নেই। থাকলে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করা হতো, মন্ত্রী হওয়ার আগে দিলীপ বড়ুয়া কীভাবে তাঁর সংসার চালাতেন, কীভাবে তিনি মন্ত্রী হওয়ার পর একাধিক প্লটের মালিক হলেন! এ প্রশ্ন করা হলো না। দিলীপ বড়ুয়া এড়িয়ে যেতে পারলেন অতীত নির্বাচনগুলোতে তাঁর ভরাডুবির প্রসঙ্গটিও। তিনি বরং উপদেশ দিলেন টক শোতে নাগরিকদের কীভাবে কথা বলতে হবে তা নিয়ে। বড়ুয়ার সোজাসাপ্টা প্রেসক্রিপশন: সমালোচনা করার আগে সরকারের ভালো জিনিসগুলো আগে বলতে হবে!
দিলীপ বড়ুয়ার এই তত্ত্ব চমকপ্রদ! তিনি একবার বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বলতে হলে রাজনীতিতে এসে তা করতে হবে। এ জন্য তাঁর সমালোচনা করার আগে তাহলে আমাদের প্রথমে এই প্রশংসা করতে হবে যে, তাঁর আমলে দেশে একটি সার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! বড়ুয়ার তত্ত্ব প্রয়োগ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ করার আগে আমাদের অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে হবে যে, অন্য প্রকল্পগুলোতে এখনো দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। দেশের কোথাও ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না, এটি বলার আগে সরকারকে আমাদের এই বলে ধন্যবাদ জানাতে হবে যে, বাকি ১৮ ঘণ্টা সেখানে বিদ্যুৎ ছিল! গুম সম্পর্কে বলতে হবে যে, দেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র শ-খানেক ব্যক্তি গুম হয়েছে, বাকিরা গুম হয়নি! সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ব্যর্থতার সমালোচনা করার সময় এটিও বলতে হবে যে, সরকার সচিবালয়ে বোমা বিস্ফোরণের মতো মামলাগুলোতে দ্রুত তদন্তের অনন্য নজির স্থাপন করেছে! তিস্তার পানি পেতে বা সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনার সময় এই প্রশংসাও করতে হবে যে, ভারত অনুদার হলেও সরকার ভারতকে অকাতরে সবকিছু প্রদান করে বন্ধুত্বের অনন্য নজির স্থাপন করেছে!
বড়ুয়া-তত্ত্ব আরও বিশদভাবে প্রয়োগ করে দেশে অহিংসা আর শান্তির ঢল বইয়ে দেওয়া যায়। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক যৌন নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত হলে প্রথমে আমাদের বলতে হবে, যৌন নির্যাতক হলেও তিনি ঠিকমতো ক্লাস নিতেন, যৌন নির্যাতনের আগে তাঁর অর্ধশত গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আদালতকক্ষে কোনো বিচারকের অশালীন বক্তব্যের সমালোচনা করার আগে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল কি না! কোনো সাংবাদিককে হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত করার আগে আমাদের গুনে দেখতে হবে, তিনি এর আগে কত বছর সাদা সাংবাদিকতা করেছেন। দুই ঘণ্টার জন্য চিকিৎসকেরা প্রয়াত বা জীবিত কোনো নেতার বন্দনা করার জন্য হাসপাতাল ছেড়ে গেলে আমাদের প্রথমে কত ঘণ্টা তিনি রোগী দেখেছেন, তার প্রশংসা করতে হবে!
বড়ুয়াকে ধন্যবাদ! তিনি টক শোকে মিষ্টিময় করার উপায় বাতলে দিয়েছেন। সরকারে থাকলে মানুষ কীভাবে চিন্তা করে, তা-ও অকপটে প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনে বারবার জামানত হারানো, খালেদা জিয়ার একসময়ের সফরসঙ্গী এই নেতাকে কেন মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলো, তা-ও কিছুটা এখন বোঝা যাচ্ছে।
সমস্যা হলো, বড়ুয়া-তত্ত্বে কোনো আত্মসমালোচনা নেই, আত্মগ্লানিও নেই। এসব থাকলে অবশ্য চারদিকে এত অভাব-অভিযোগের মধ্যে নেতা-নেত্রীরা ঘুমাতে পারতেন না শান্তিতে। আমাদের জানা উচিত, নেতাদের আরামদায়ক ঘুম জনগণের ঘুমের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.