ধর্ম-মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম মা হিসেবে নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছে এবং মুসলিম পরিবারে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বের স্থান দিয়েছে, তা ইতিহাসে বিরল। ইসলাম মাকে মহিমান্বিত করে প্রকৃতপক্ষে নারী জাতির মর্যাদাকেই সমুন্নত করেছে।


মাতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম নারীকে দিয়েছে সম্মানজনক মর্যাদা। সন্তানের সার্বক্ষণিক মঙ্গল কামনায় মায়েরা অনেক ত্যাগ করেন, যথাসম্ভব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেন। সন্তানকে সুস্থ ও সৎমানুষ রূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মায়েদের আজীবন সাধনাকে অম্লান করতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণীতে ঘোষিত হয়েছে, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ (আহমাদ, নাসাঈ)
মহান সৃষ্টিকর্তা নারীকে প্রদান করেছেন মাতৃত্বের অধিকার তথা গর্ভধারণের ক্ষমতা। আল্ল্লাহ রাব্বুল আলামিন নারী জাতির মাধ্যমে দুনিয়ায় মানব বংশধারা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করেন। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব-বৈচিত্র্যের মতো বিশাল মানবসম্পদের উন্নয়ন, যথাযথ লালন-পালন ও রক্ষণাবেক্ষণে মায়েদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা তাঁদের প্রতি তোমাদের দয়ার বাহু নত করে দাও এবং বলো: হে আমার প্রতিপালক! তুমি তাঁদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৪)
ইসলাম সন্তানের ওপর পিতা অপেক্ষা মাতার অধিকার বেশি রেখেছে। কেননা নবজাত শিশুর লালন-পালনের জন্য মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কষ্ট অপরিহার্য। সন্তান ধারণ ও প্রসবের নানা পর্যায়ে মাকে কঠিন বেদনায় ক্লিষ্ট হতে হয়। গর্ভধারণের সময়ে কষ্ট, প্রসবকালীন অসহনীয় বেদনার কষ্ট সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাকেই বহন করতে হয়। নয় মাস গর্ভে ধারণ করে মা তাঁর নবজাতককে অসহনীয় যন্ত্রণাভোগ করে জীবন-মরণের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে প্রসব-বেদনার অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে এ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ করে। মায়ের গর্ভকালীন কষ্টের কথা আল্লাহ তাআলা ব্যক্ত করেছেন, ‘আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি, তার মা তাকে কষ্টের ওপর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে, সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৪) । অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করে এবং কষ্টের সঙ্গে প্রসব করে, তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়াতে লেগেছে ৩০ মাস।’ (সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, অতঃপর মাতার সঙ্গে, অতঃপর মাতার সঙ্গে, অতঃপর পিতার সঙ্গে, অতঃপর নিকট-আত্মীয়ের সঙ্গে।’ আল্লাহ তাআলা পিতার চেয়েও মায়ের অধিকার ও মর্যাদাকে কত উচ্চপর্যায়ে স্থান দিয়েছেন এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ‘একদা এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকারী কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ওই ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। ওই ব্যক্তি আবার জিজ্ঞাসা করল, তারপর? তিনি এবারও বললেন, তোমার মা। ওই ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, তারপর? তিনি এবার বললেন, তারপর তোমার পিতা।’ (বুখারি)
প্রকৃতিগতভাবেই পিতামাতা বার্ধক্যে উপনীত হয়ে সন্তানের সেবাযত্নের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে এবং তাঁদের জীবন সন্তানের দয়া ও কৃপার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ সময় মাতাপিতার যাতে সামান্যতম কষ্টও না হয়, সে জন্য সন্তানের প্রতি আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তোমাদের সামনে তাঁদের একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের ‘উফ্’ বোলো না এবং তাঁদের ধমক দিয়ো না; আর তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক নম্র কথা বলো।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)
মুসলিম পরিবারে সন্তানের মা সব সদস্যের কাছ থেকে সম্মানজনক মর্যাদা ও সদাচরণ পাওয়ার দাবিদার। সন্তান জন্মের সূচনাপর্ব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মায়ের অবদান অতুলনীয়। তাই মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিনয়, সদাচরণ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের বাণী পবিত্র কোরআনে যথাযথ ও সুবাচনিক ভঙ্গিতে বিধৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর শরিক করবে না এবং পিতামাতার প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৩৬) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, একদা এক ব্যক্তি এসে প্রশ্ন করল পিতামাতার ইন্তেকালের পরও তাঁদের কোনো হক আমার জিম্মায় আছে কি?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন: ‘হ্যাঁ, তাঁদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা, তাঁদের যাবতীয় অঙ্গীকার পূরণ করা, তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখা।’ (ইবনে মাজা)
সন্তানের গোটা জীবনই হচ্ছে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের সময়, এমনকি মায়ের মৃত্যুর পরও সন্তানের এ দায়িত্ব কখনো শেষ হয় না। মানব সন্তানেরা মায়ের ত্যাগের কথা বেমালুম ভুলে সত্য স্বীকার করতে চায় না বলেই বিশ্বজুড়ে গৃহে বা বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের প্রতি বঞ্চনা, অবহেলা আর অবজ্ঞার বার্তা শোনা যায়। প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে মায়ের প্রতি অসদাচরণ ও অবহেলা করে বহু সন্তান বিপথগামী বা ভর্ৎসনার পাত্রও হয়েছে। তাই প্রত্যেক সন্তানসন্ততির অপরিহার্য কর্তব্য সব সময় মাতাপিতার প্রতি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল হওয়া, তাঁদের মান্যগণ্য করা, তাঁদের সঙ্গে বিনম্র ও সদয় আচরণ করা, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, বার্ধক্যে উপনীত হলে যথাসাধ্য সেবা-শুশ্রূষা, প্রয়োজনবোধে তাঁদের ভরণপোষণ প্রদান করা এবং যত দূর সম্ভব তাঁদের জীবন আরামদায়ক করা। মা-বাবার ইন্তেকালের পর ছেলেমেয়েদের সমীচীন হবে তাঁদের ক্ষমা ও কল্যাণের জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা এবং তাঁদের কোনো অঙ্গীকার থাকলে যথাশিগগির তা পূরণ করা।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.