মেঘের চিঠি, আকাশের ঠিকানায় by ফারজানা খান গোধূলি

সোনামানিক, গুটলা পুটলা, বাবু সোনা, জান পাখি, গুটুবাচ্ছা উঠে পড়ো, সকাল হয়ে গেছে, স্কুলে যেতে হবে, ওঠো ওঠো  বাবাআমার! প্রতিদিন সকালে কপালে হামি দিয়ে তুমি বা বাবা আমার ঘুম ঘুম চোখে পানি দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাও। তুমি আমাকে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে দাও।

আমি চোখ খুলতে না চাইলেও বাবা বা তুমি আমাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যাও। এবার আমি চোখ খুলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলি মিম্মি আমাকে একটা বড় চকলেট দাও, তুমি আমাকে বল, ওকে গুড বেবি হয়ে ক্লাস কর, আমি অফিস থেকে ফেরার সময় বড় চকলেট নিয়ে আসবো।
প্রতিদিন আমি রাতে ঘুমাই। ভাবি চোখ খুললেই তোমাকে দেখবো। তোমার কথা শুনে চোখ খুলতে চাই। মিম্মি হঠাৎ করে কেন তুমি আর বাবা এক সকালে নেই হয়ে গেলে, কোথায় চলে গেলে, আমাকে ছেড়ে আল্লাহ’র কাছে কি তোমাদের ভালো লাগে। আমার একটুও ভালো লাগে না। সবাই আমাকে খুব আদর করে, যা চাই তাই এনে দেয়। স্কুলে না গেলেও কেউ কিছু বলে না। সারাদিন খেলতে দেয়। কিন্তু মা আমার এখন সারাদিন খেলতে ভালো লাগে না। কেউ খুব জোর করে স্কুলে নিয়ে যায় না তোমার মতো করে। সবাই কেমন করে তাকায় আমার দিকে। ভালো লাগে না। মিম্মি, জানো যেখানেই যাই সবখানে পুলিশ যায়, জানো না আমি এখন অনেক কিছু বুঝি, বড়রা জানে না। আমিও বলি না।

মিম্মি, তুমি আগে বকা দিলে, মনটা খারাপ করে কান্না করতাম, রাগ করতাম, ভাবতাম তোমার সাথে কথাই বলব না। ভাতও খাবো না। মিম্মি, এখন মনে হয় তুমি এসে বকলেও আমি কান্না করবো না। তোমাকে জড়িয়ে তোমার গালে হামি দেব, তোমার কোলে শুয়ে থাকবো। মিম্মি আমি আর চকলেট চাইবো না। গুড বয় হয়ে থাকবো। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলেও যাবো। তুমি আর বাবা শুধু ফিরে আসো। আমি কোন টয় চা’বো না, লক্ষী ছেলে হয়ে থাকবো, মিম্মি প্লিজ আমি আর দুষ্টুমি করবো না। আমি আর কিছু চাই না, শুধু তোমাদের দুজন কে চাই। সেদিন বড়রা চুপিচুপি কথা বলছিলো, তোমাদের কে নাকি কেউ আবার ডেকেছে, টেলিভিশনে দেখলাম তাঙ্কা আজিমপুর গিয়েছে। আমাকে নেয়নি। সবাই মনে করেছে আমি কিছু বুঝিনি। কিন্তু আমি একটু একটু শুনলাম বাবা আর তুমি নাকি হাসপাতালে যাচ্ছ, পুলিশরা তোমাদের নিয়ে যাচ্ছে। আমি সেইদিন থেকে অপেক্ষা করছি বাবা আর তুমি চলে আসবে, সেই আগের মতো আমরা তিনজন আবারো একসাথে থাকবো। দরজাতে নক হলেই আমি বারবার দৌড়ে যাই। তুমি আর বাবা এসেছো। কিন্তু কেন আসো না। হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে এসো। আমার একদম ভালো লাগে না। আমার কিছু না শুধু বাবা-মা চাই।

স্কুলে সবাই মা বাবার সাথে আসে। ছুটি হলে বন্ধুদের কেউ কেউ বাবা বা মার কোলে চড়ে বাসায় যায়। মিম্মি, আমি তোমার আর বাবার কোলে কতদিন উঠিনি। আমাকে একটু কোলে নাও না। মিম্মি তুমিতো আমাকে ছেড়ে থাকতেই পারো না, এখন তাহলে কেন ছেড়ে গেলে আমাকে, একা কিছু ভালো লাগেনা। মিম্মি গো, আমি তোমার কাছে যাবো। মিম্মি, আমাকে তুমি ভাত খাইয়ে দাও। আমি তোমার হাতে খাবো। তোমার হাতে খেতে আমার সব থেকে বেশি ভালো লাগে। মিম্মি জানো সেদিন তাঙ্কা পাজল গেম কিনে দিয়েছে। আমি খুব তাড়াতাড়ি পাজল মিলিয়ে ফেলেছি। আমি কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলি অনেক সময় ধরে খেলি কেউ কিছু বলে না। আগে তুমি আর বাবা অল্প সময় খেলতে বলতে। বাবা আর তুমি চলে এলে আমি আর বেশি বেশি গেমস খেলবো না। সবাই বলে, তোমরা খুব ভালো তাই আল্লাহ তোমাদের নিয়ে গেছে, আল্লাহ ভালোদের নিয়ে যায়, মিম্মি আমি কি ভালো বেবি না? সবাই তো আমাকে বলে আমি গুড বেবি তাহলে ওরা কেন শুধু তোমাদের আল্লাহ্‌র কাছে পাঠিয়ে দিলো? আমাকে কেন পাঠালো না? আমি কি পচা বেবি? আমার কিছু ভালো লাগে না, আস না মা জলদি করে। জানো, আমি দাদু, নানুর সাথে হাসিনা আন্টির বাসায় গিয়েছিলাম। তোমাকে আর বাবাকে কারা আল্লার কাছে পাঠিয়ে খুঁজে দেবার জন্য, হাসিনা আন্টি আমাকে অনেক আদ্র করল, দাদু-নানুকে প্রমিস করল। কিন্তু আজো কিছুই জানালো না।আমি আমার সব টয় উনাকে দিয়ে দেব, সব চকলেটও দিয়ে দেব, তাহলে হাসিনা আন্টি নিশ্চয় খারাপ লোকদের খুঁজে বের করবে।

তুমি আর বাবা যখন ছিলে তখন তোমাদের অনেক বন্ধু আমাকে আদর করত। বাসায় আসত। এখন কেউ আসে না। শুধু কিরণ আন্টি আর পুতুল আন্টি আসে। ওরা আমাকে বেড়াতে নিয়ে যায়। বাবা আর তুমি ছাড়া কারো সাথে বেড়াতে এখন ভালো লাগে না। এবার তোমরা ফিরে এলে আমরা আবার অনেক দূরে দেশে চলে যাবো। তাহলে পচা লোকগুলো আর তোমাদের মেরে ফেলতে পারবে না, আল্লাহ্‌র কাছে পাঠাতে পারবে না। মা, তুমি আর বাবা আল্লাহ্‌র কাছে গুড বেবি না হয়ে একটু বেশি দুষ্টুমি করো। আল্লাহ তো ব্যাডদের পছন্দ করে না। তোমরা বেশি দুষ্টুমি করলে আল্লাহ তোমাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি তাহলে আর রাতে ভয় পাবো না।

জানো মিম্মি, আমি আর একা ঘুমাতে পারি না। খুব ভয় করে । খালি মনে হয় চোর এসেছে, মামা আর নানুকেও মেরে ফেলবে। মিম্মি জানো, নানু না লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করে, আমি দেখে ফেললে বলে কই না তো কান্না করছি না তো! সবাই আস্তে আস্তে কথা বলে আমাকে দেখলে থেমে যায়, মনে করে আমি ছোটো কিছু বুঝি না। মা, স্কুলে সবাই বারে বারে বলে তোমার বাবা-মা কে খুন করেছে, দেখেছো তাদের? তোমরা নাকি আর ফিরে আসবে না? সত্যি কি আসবে না। আমি প্রমিস করছি মিম্মি, একদম গুড বেবি হয়ে থাকবো। সকালে ঘুম থেকে উঠবো, স্কুলে যাবো। ঠিক মত দুধ খাবো। ঘুমাবো। বেশি গেমস খেলব না। তুমি আর বাবা যা বলবে আমি তাই শুনব। তুমি বলেছিলে, তোমার একটা ছবি আঁকতে। বাবার যেমন এঁকেছিলাম। জানো মিম্মি এখন ছবি আঁকতে গেলে শুধু তুমি, বাবা আর অনেক রক্ত পড়ে আছে দেখি। কিন্তু মা তুমি চলে এলে আমি তোমাকে মা-দিবসে সত্যি সত্যি একটা ছবি এঁকে দেবো। তুমি বলেছিলে মা দিবসে তোমাকে একটা ছবি এঁকে দিতে। আমার সব বন্ধুর বাবা-মা আছে ওদের কাছে। আমার বাবা-মা নেই কেন? সবাই মা দিবসে মজা করবে, আম্মুরা সব বেবিদের নিয়ে অনেক মজা করবে। মা, আমাকে নিয়ে কে মজা করবে। আমি কাকে মা বলে ডাকবো? আমি আমার বাবা মার আদর চাই। আল্লাহকে তোমরা বল আমি কিছু চাই না শুধু বাবা-মা চাই। আমার সব কথা তোমাকে লিখলাম। ঘুড়িতে বেঁধে আকাশে পাঠাচ্ছি চিঠিটা, মিম্মি তুমি পড়ে চলে এসো কিন্তু! বাবা কে বল। এক সকালে যেমন হঠাৎ করে চলে গিয়েছ ঠিক তেমনি আর এক সকালে ফিরে আসবে, নইলে কিন্তু আর চিঠি লিখবো না। মিস করো না মা। আমি তোমার একটা ছবি এঁকে তোমার জন্য ওয়েট করবো।
বাবা আর তোমার ছোট্ট মেঘ

ছোট্ট মেঘ আকাশের ঠিকানাতে লেখা চিঠি সাগর রুনি কি পড়ছে আর কি অভিসম্পাত করছে নিজেদের দেশাত্ববোধের জন্য, যে দেশপ্রেম ওদের সাত বছরের বাচ্চাটাকে এতিম করে দিলো অকালে তার জন্য। তিন মাস হয়ে গেল। নিষ্ঠুর খুনের কোনো কিনারা আজো হল না। বন্ধুরাও নেই আর পাশে। নেই ছেলেটার পাশে না ওদের বয়স্কা অসহায় মায়েদের পাশে। সবাই ব্যস্ত যার যার কাজে। ছেলেটাকে কেউ কি নেই বাবা-মার মতো আদর দেবার। বন্ধুদের দেখে কি আরও কষ্ট পাচ্ছে? ও বাবা-মা কি চিঠি পড়ছে? ওরা কি মেঘের পাশে শুভ্র মেঘ হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। নাকি মেঘের মতো অশ্রুর মেঘ বুকে চেপে করুন চোখে তাকিয়ে আছে দূর থেকে। দূর থেকে চাইছে মেঘকে গভীর মমতায় বুকে টেনে নিতে।

ফারজানা খান গোধূলি: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
Jewel_mazhar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.