সাময়িক প্রসঙ্গ-সংবিধান সংশোধন নিয়ে কিছু প্রস্তাব by হেলাল উদ্দিন আহমেদ

স্থানীয় সরকার পদ্ধতি যদি জাতীয় উন্নয়নের স্তর হয়ে থাকে তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদের মতো জেলা পরিষদে গণতান্ত্রিকভাবে প্রত্যেক জেলার জন্য একজন করে গভর্নরের বিধান করা যেতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত হবে এবং আমাদের দেশকে আর স্বল্পোন্নত দেশের বেড়াজালে থাকতে হবে না সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার একটি পবিত্র দলিল।


এই দলিলটি সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তিত, পরিমার্জিত ও সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশ সরকারও ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যবিশিস্ট সংবিধান সংশোধন কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এই কমিটির মধ্যে আলোচনা ও বহু বৈঠক হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সাংবাদিক, বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসহ জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এটি চলতি জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনে পরিণত করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনা ও দেশ পরিচালনার জন্য ৩টি অঙ্গ রয়েছে। যেমন পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ সংবিধানে স্থাপিত ৫৮ অনুচ্ছেদে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কনসেপ্ট বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং দলীয় সরকারের অধীনেও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দেওয়া থাকলেও তা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম নয়। দেশে অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলছেন। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না। তাই নির্বাচন কমিশনকে তিন অঙ্গের সঙ্গে রাষ্ট্রের আরও একটি অঙ্গের বিধান করা যেতে পারে। এতে জাতীয় কিংবা যে কোনো নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারবে এবং দেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত থাকবে।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনে প্রতীকসহ ৩৮টি দল রেজিস্ট্রিভুক্ত আছে। জোটের মাধ্যমে নির্বাচন হওয়ার বিধান আছে। নির্বাচন কমিশনে প্রত্যেক দলের প্রতীক থাকা সত্ত্বেও অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা অনৈতিক বলে মনে করি। প্রত্যেক দলের প্রতীক থাকা সত্ত্বেও অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে দলসহ তার দলের প্রতীক বাতিল বলে গণ্য হওয়ার বিধান থাকতে পারে।
বিগত ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশ ডিসি (উন্নত), ইউডিসি (উন্নয়নশীল) নয় বরং এলডিসি (স্বল্পোন্নত) দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে অনেক দেশই তাদের মেধা ও কার্যকলাপ দ্বারা এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিগত ৪০ বছরের সমীক্ষা করে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আমলে উন্নয়ন হয়েছে বেশি। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার চলছে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের বিধানও থাকতে পারে। যদিও গণভোটের প্রয়োজন হবে। বর্তমান পদ্ধতিতে দেশ চলতে থাকলে আগামী ১০০ বছরেও এলডিসির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
বর্তমানে দেশে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার চলছে। রাষ্ট্রপতি থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে তিনি কিছুই করতে পারেন না। তিনিই বাংলাদেশের সব ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের সঙ্গে তার কোনো তফাত নেই। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী এককভাবে সব ক্ষমতার অধিকারী; সেহেতু ১৮৯৭ সালের জেনারেল অ্যাক্লজ অ্যাক্ট : এর ১৭ এবং ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ নির্বাহী পদ একদিনের জন্যও খালি থাকতে পারবে না। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী একজন মানুষ। তিনিও আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকতে পারেন কিংবা দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে যেতে পারেন। যদিও বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের কোনো বাধা নেই। মন্ত্রিপরিষদ সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক-দু'জন উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন। সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উপ-রাষ্ট্রপতি পদ থাকতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদের সংখ্যা ১০ জন বৃদ্ধি করে ১৫ জনের বিধান করা যেতে পারে। বর্তমানে সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার কিংবা বিরোধীদলীয় একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য একটানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ খারিজ হবে। একজন সংসদ সদস্য সংসদে ৫ বছরে মাত্র ৫ দিন উপস্থিত থাকলেই তার সদস্যপদ থাকে। এই ৯০ দিন কার্যদিবসের পরিবর্তে ৩০ দিন কার্যদিবস করার বিধান করা যেতে পারে।
দেশের ক্রান্তিকালীন সময়ের জন্য কিংবা সংকট সৃষ্টি হলে তা নিরসনকল্পে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (ঘঝঈ) বিধান থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে ব্যর্থ হলে এই পরিষদের ১৫ জনের একটি প্যানেল গণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে একজন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেবে। তিনিই উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে ব্রতী হবেন।
বর্তমানে জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর বা অনেকের কাছে দীর্ঘ সময়। তাই ৫ বছরের পরিবর্তে ৪ বছরের বিধান হতে পারে, যা অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই আছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম মিডিয়াতে একই মত পোষণ করেছেন। ফলে দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন কিংবা কোনো রাজনৈতিক সংঘাত থাকবে না।
জাতীয় সংসদের নির্বাচন শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে হওয়ার বিধান থাকতে পারে। বিগত ৩৮ বছর ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩০০ আসনে হয়ে আসছে এবং বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন ছিল। বর্তমানেও সংরক্ষিত মহিলা আসন ৪৫ আছে; সংসদ নির্বাচনে ৪০০ আসনের বিধান করা যেতে পারে। তবে সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিধান থাকবে না। স্থানীয় সরকার পদ্ধতি যদি জাতীয় উন্নয়নের স্তর হয়ে থাকে তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদের মতো জেলা পরিষদে গণতান্ত্রিকভাবে প্রত্যেক জেলার জন্য একজন করে গভর্নরের বিধান করা যেতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশ উন্নয়নশীল (টউঈ) দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত হবে এবং আমাদের দেশকে আর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের বেড়াজালে থাকতে হবে না।

অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন
আহমেদ :রাজনীতিক

No comments

Powered by Blogger.