চরাচর-ঢাকার মগরা হারিয়ে গেল by আজিজুর রহমান

এককালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করত এমন একটি জাতিগোষ্ঠীর নাম হচ্ছে মগ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তসংলগ্ন আরাকান রাজ্য থেকে কয়েক শতাব্দী আগে মগরা বাংলার রাজধানী ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। আরাকান একসময় স্বাধীন রাজ্য ছিল। পরবর্তীকালে এটি মিয়ানমার প্রজাতন্ত্রের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
আরাকানের প্রাচীন নাম রাখাইন প্রে। মগরা এ জন্য নিজেদের রাখাইন জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। মগরা মঙ্গোলীয় মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত ভোট-বর্মি জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র শাখা। এদের দৈহিক গঠন অনেকটা মঙ্গোলীয়দের মতোই। ঐতিহাসিকদের মতে, অষ্টম শতক থেকেই মগরা বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। তবে ১৫ শতক থেকে এবং পরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়ে মগরা মাতৃভূমি ত্যাগ করে বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ১৭ শতকের প্রথমদিকে রাজনৈতিক কারণে মগদের একটি দল তৎকালীন ঢাকার উত্তর এলাকার শেষপ্রান্তে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
আরাকানের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন রাজা মলহন (১৬১২-২২ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর মুসলিম নাম ছিল হুসেন শাহ। আরাকানি উচ্চারণ উ-শং-শিয়া (Oo-Shyoung-shya)। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা মলহন ওরফে হুসেন শাহর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজা শ্রীসুধর্ম ওরফে সেলিম শাহ (দ্বিতীয়) আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা শ্রীসুধর্মের (১৬২২-৩৮ খ্রিস্টাব্দ) ছোট ভাই মেঙ্গতরায় ধরমসা তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলের গভর্নর বা সুবাদার ছিলেন। রাজা শ্রীসুধর্মের রানির নাম ছিল নাৎসিনমি। তাদের একমাত্র শিশুপুত্রের নাম মিনসানি। রাজসভায় নরপতি নামে রাজার এক আত্মীয় ছিলেন মন্ত্রী। এই মন্ত্রীর সঙ্গে রানির ছিল গোপন প্রণয়। এদের ষড়যন্ত্রের কারণে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা শ্রীসুধর্ম ও শিশুপুত্র মিনসানিকে হত্যা করা হয়। রানি নাৎসিনমি তার প্রেমিক নরপতিকে রাজা বানিয়ে সিংহাসন দখল করে নেয়। সেই সঙ্গে সাবেক রাজার জ্ঞাতিবর্গ ও সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যার আদেশ জারি করা হয়। ফলে প্রাণভয়ে রাজার হাজার হাজার অনুসারী চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। এ হত্যাকাণ্ড ও সিংহাসন জবরদখলের সংবাদ পেয়ে চট্টগ্রামে অবস্থানরত রাজার ছোট ভাই মেঙ্গতরায় ধরমসা ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সিংহাসন জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু নৌবাহিনীর দুর্বলতার কারণে যুদ্ধজয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হন। সেই রাজনৈতিক গোলযোগের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা এবং দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে কমপক্ষে ৫৫ হাজার মগ বা আরাকানি আশ্রয় নেয়। মেঙ্গতরায় ধরমসা তাঁর পরিবার-পরিজন, নেতৃস্থানীয় সমর্থকসহ প্রায় ১০-১২ হাজার অনুচর এবং ১৯টি হাতি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি মোগল সুবেদার ইসলাম খান মাসহাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং তাঁকে তিনটি হাতি উপঢৌকন দেন। সুবাদারও মেঙ্গতরায়কে পাঁচ হাজার টাকা উপহার দেন এবং মনসব ও জায়গির প্রদান করেন। মেঙ্গতরায় ধরমসা নিজ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব মোগলদের হাতে অর্পণ করেন এবং নিজেকে সম্রাট শাহজাহানের করদ রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ও তাঁর পরিবার এবং সব সমর্থক নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মেঙ্গতরায় ধরমসার নতুন নাম হয় মীর আবুল কাশেম আল হুসেনি আত-তাবাতাবাই আল-সমনি। সুবাদার তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন তৎকালীন ঢাকা শহরের তিন মাইল উত্তরে এক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে। যা পরবর্তীকালে মগবাজার নামে পরিচিতি লাভ করে।
আজিজুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.