মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপ ২০১২-অস্ট্রেলিয়ার পথে বাংলাদেশ by নুরুন্নবী চৌধুরী

উত্তেজনাময় সময়ে সবার মনোযোগ ঘোষকের দিকে! কারণ, নির্বাচিত সেরা প্রকল্পটি যাবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে। আর এমন আয়োজন ছিল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাইক্রোসফট আয়োজিত বিশ্বের অন্যতম সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিযোগিতার বাংলাদেশের চূড়ান্ত পর্বে।


মাইক্রোসফট বাংলাদেশের উদ্যোগে দ্বিতীয় বারের মতো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করা হয় এ সফটওয়্যার ডিজাইন প্রতিযোগিতা। মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ডেভেলপার এভেনজেলিস্ট অমি আজাদ জানান, গত ডিসেম্বর মাস থেকে দেশব্যাপী ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমাজিন কাপের প্রচারণা চালানো হয়। আর এতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন শতাধিক দল অংশগ্রহণের আবেদন করে এবং সেখান থেকে ১৪টি দলের আবেদন প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে তাদের দ্বিতীয় পর্বে উত্তীর্ণ করা হয়। তিনি জানান, দ্বিতীয় পর্বে প্রতিযোগীদের চ্যালেঞ্জ ছিল প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী সমাধান তৈরি করা। এ পর্বে নয়টি দল তাদের প্রকল্প সফলভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়। এ প্রকল্পগুলোতে কী ধরনের কাজ হয়েছে, সেসব বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে নয়টি প্রকল্প সম্পর্কে দর্শনার্থীদের বিভিন্ন মতামত নেওয়া হয়।

ইমাজিন কাপের কথা
বর্তমান প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের বড় বড় সমস্যা সমাধানে সারা পৃথিবীর মেধাবী শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে শুরু হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিযোগিতা ‘মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপ’। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি চ্যালেঞ্জকে লক্ষ্য রেখে সমাধান তৈরি করতে আহ্বান জানানো হয় শিক্ষার্থীদের। এ বছর জুলাই মাসে দশম বারের মতো অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আয়োজিত হবে মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপ ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফাইনাল পর্ব। ২০০৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এ ছাড়া চূড়ান্ত পর্বে ১৮৩টি দেশের চার লক্ষাধিক শিক্ষার্থী প্রতিনিধি অংশ নেয়।

সেরা তিন প্রকল্প
চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় সেরা তিনটি প্রকল্প ছাড়াও পুরস্কৃত করা হয় তিনটি দলকে, যারা সুন্দর ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল কিন্তু প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করতে পারেনি। সুন্দর ধারণা থাকায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইউআইইউ-স্ট্রাগলার দলের ‘ইউআইইউ বাংলা ওসিআর’ প্রকল্প, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমওআর দলের ‘আই কেন্ট্রাল্ড কার্সর’ প্রকল্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির আইআইটি ফনিক্স দলের ‘বেটার টুগেদার’ প্রকল্পকে পুরস্কৃত করা হয়।

কৃষিজমির উপযুক্ততা অনুযায়ী বীজ ও সার
কৃষিজমির উপযুক্ততা অনুযায়ী কী পরিমাণ সার, কী প্রজাতির বীজ লাগবে—এ বিষয়টি নিয়ে তৈরি প্রকল্পের মাধ্যমে ইমাজিন কাপের বাংলাদেশ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বিত ইঞ্জিন দলের ‘অন্নপূর্ণা’ প্রকল্প। এ দলের চার সদস্য খালেদ মাহমুদ, আইমান কাদের সিদ্দিকী, মেহনাজ চৌধুরী ও মোহাম্মদ জুনায়েদ হাসান অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনুষ্ঠেয় ইমাজিন কাপের ওয়ার্ল্ডওয়াইড পর্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। দলের সদস্য মেহনাজ চৌধুরী জানান, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও খাদ্য ঘাটতির বিষয়টি বিশ্বব্যাপী বড় একটি সমস্যা। আর বিশ্ব খাদ্য ঘাটতির এ সমস্যা মোকাবিলায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার অনস্বীকার্য। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে এর প্রচলনের প্রধান বাধা কৃষকের উপযুক্ত জ্ঞানের অভাব। আর এ সমস্যা সমাধানে আমরা তৈরি করেছি অন্নপূর্ণা নামের বিশেষ এ জিআইএসভিত্তিক সফটওয়্যার। ‘এ সফটওয়্যার মুঠোফোনের সাহায্যে কৃষককে জমির উপযুক্ততা অনুযায়ী, আধুনিক ও উচ্চফলনশীল প্রজাতির বীজ ও সার সুপারিশ করতে সক্ষম। এ সফটওয়্যার একটি নিজস্ব ভৌগোলিক মানচিত্রসেবার সাহায্যে খরা, লবণাক্ততা ও বন্যাকবলিত ভূমি নির্ণয় করে সহনশীল জাতের বীজ চাষাবাদের পরামর্শও দেয়—বললেন দলের আরেক সদস্য খালেদ মাহমুদ। বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক সারের অপব্যবহার ও ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সমাধানে এ সফটওয়্যার কৃষকের বীজ ও মাটির উপযুক্ততা অনুযায়ী সঠিক পরিমাণ সার ব্যবহারের সুপারিশ করে থাকে, যা মাটির গুণাগুণ সংরক্ষণ ও শস্যের ফলন বৃদ্ধিতে অপরিহার্য। এ ছাড়া এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে মুঠোফোনের সাহায্যে একজন কৃষক অতি সহজেই পোকা ও রোগব্যবস্থাপনাসহ উন্নত জাতের বীজ চাষাবাদের বিবিধ কার্যপ্রণালির তথ্যসেবা পাবেন—বললেন আইমান কাদের সিদ্দিকী ও মোহাম্মদ জুনায়েদ হাসান।

কৃষিজমিতে সার ও রোগ চিহ্নিতকরণ
কৃষিজমিতে থাকা সবুজ ফসলের ছবি থেকে ফসলি জমিতে কতটুকু সার লাগবে এবং রোগ চিহ্নিত করে এর প্রতিকার দেবে—এমন প্রকল্প তৈরি করে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ‘লেপ্রেকন’ দলের ‘প্রজেক্ট বিটল’ প্রকল্প। এ দলের সদস্যরা হলেন: রাহাত ইয়াসির, সাইফ তাইফুর, শুভ কুমার পাল ও জিল্লুর রহমান।
শুভ কুমার পাল জানান, খাদ্য সমস্যা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিবছর সারা বিশ্বের বিপুল মানুষ খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বহু মানুষ বর্তমানে খাদ্য অনিরাপত্তায় ভুগছে। আর তাই খাদ্যের নিরাপত্তা দিতেই আমরা এ প্রকল্পটি তৈরি করেছি। দলের আরেক সদস্য রাহাত ইয়াসির বলেন, এ সফটওয়্যারের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ফসলের রোগ চিহ্নিত করে কৃষকদের সঠিক প্রতিষেধক ব্যবহার করার উপদেশ দেওয়া। এ ছাড়া বিটল ফসলের সবুজ পাতার ছবি থেকে ফসলি জমিতে কতটুকু সার দিতে হবে, তা কৃষককে নির্দেশ করবে। যার ফলে কৃষক সঠিক উপায়ে সার প্রয়োগ করে ফসলের উৎপাদন অনেকাংশে বাড়াতে পারবেন।
কৃষক বিটল সফটওয়্যার দিয়ে রোগাক্রান্ত পাতার ছবি তুলবেন, ছবিটি বিটল নানা ধাপের মাধ্যমে তার নিজস্ব লোকাল ডেটাবেইসে রাখা তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। যদি ছবির ধরনের সঙ্গে ডেটাবেইসে রাখা ছবির ধরন মিলে যায়, তাহলে বিটল ওই রোগের সঠিক প্রতিকার কৃষককে দেবে। যদি তোলা ছবির ধরন লোকাল তথ্যের সঙ্গে না মেলে, তাহলে বিটল ক্লাউড ডেটাবেইসে রাখা তথ্যের সঙ্গে ছবির ধরন মিলিয়ে দেখে সঠিক প্রতিকার দেবে। প্রজেক্ট বিটল বর্তমান ফসলের রোগের শতকরা ৫০ ভাগ সমস্যা সমাধান করতে পারলেও প্রজেক্ট বিটল দিয়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর বাঁচানো সম্ভব—বললেন সাইফ তাইফুর ও শুভ কুমার পাল।

শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের জন্য প্রযুক্তি
শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের জন্য বিশেষ প্রযুক্তি তৈরি করে তৃতীয় হয়েছে আহ্ছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অস্ট ফোরবিট’ দল। এ দলের সদস্যরা হলেন: জাওদাত ওয়াসিফুর রহমান, মাহি রায়হান ইউসুফ, ফজলে রাব্বি তানজিন ও অনিক মুশফেকি আবির। দলের সদস্য মাহি রায়হান ইউসুফ জানান, বিকলাঙ্গদের জন্য ‘হেল্পিং সিস্টেম ফর ফিজিক্যালি ডিজঅ্যাবল পিপল ইউজিং ভয়েস প্রসেসিং’ শীর্ষক এ পদ্ধতির মাধ্যমে শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষ বিশেষত, যাদের হাত বা পা নেই, তাদের কণ্ঠস্বর ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়মিত দরকারি কাজগুলো করার ব্যবস্থা করা সম্ভব। এতে করে তাদের নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে যাবে। আমরা এমন একটি সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের সমাহার, যা শুধু কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের নির্ভরশীলতা কমিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে—বললেন দলের আরেক সদস্য জাওদাত ওয়াসিফুর রহমান। এ ছাড়া এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কণ্ঠস্বরের সাহায্যে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা ঘরের সব ধরনের ইলেকট্রিক সামগ্রী যেমন ফ্যান, লাইট ইত্যাদি চালু করা ও বন্ধ করা, ফোন ধরা, ফোনে কথা বলা এবং ফোন করা, যাদের পা নেই তাদের জন্য কণ্ঠস্বরনিয়ন্ত্রিত চাকাওয়ালা চেয়ারবিশেষ, জরুরি অবস্থায় বিপদসংকেত দেওয়া ইত্যাদি কাজ করা যাবে বলে জানালেন ফজলে রাব্বি তানজিন ও অনিক মুশফেকি আবির।

No comments

Powered by Blogger.