বহে কাল নিরবধি-ইরান আক্রমণের প্রাক্কালে সম্ভাব্য দৃশ্যপট by এম আবদুল হাফিজ

গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতকে মার্কিন ভূখণ্ডেই হত্যা চেষ্টার পেছনে ইরানি হাত সক্রিয় দেখেছিলেন; যদিও ইরান এমন অনুমানকে নাকচ করেছে। কিন্তু এই এপিসোড ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।


যদিও ওবামা প্রশাসন প্রকাশ্যে এ জন্য কোনো প্রতিশোধের কথা বলেনি। মার্কিনিদের অভিযোগ, সত্যিকারের ঝুঁকি যে উভয় দেশ সত্বরই সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে- এমন আশঙ্কাকে ওপরে তুলে এনেছে, বিশেষ করে ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঘিরে।
আলোচ্য এপিসোডটির বেশ কয়েক বছর আগে মার্কিন পণ্ডিত ও নীতিনির্ধারকরা এন্তার বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন এ নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্রের কি আদৌ ইরানে আঘাত হানা এবং সে দেশের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা উচিত! এমন পদক্ষেপের সমালোচকরা অবশ্য স্বীকার করেন যে একটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত ইরানই শুধু সামরিক আঘাত হানার চেয়ে দোষণীয়। তাহলে সামরিক আঘাতে নয়, অন্য কোনো উপায়ে কি ইরানকে তার পারমাণবিক লিপ্সা থেকে নিবৃত্ত করা যায় না? তা ছাড়া সামরিক আঘাত যে শত ভাগ সফল হবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? যদিও বা তা সফল হয়, এমন আঘাত একটি সর্বব্যাপী সংঘর্ষেরই সূচনা ঘটাবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত করবে। তাঁদের যুক্তি যে ইরানকে নিবৃত্ত করার জন্য তো বেসামরিক পন্থাও প্রয়োগ করা যায়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, একই লক্ষ্য অর্জনে কূটনীতি, অবরোধ বা কভার্ট অপারেশনের প্রয়োগ হতে পারে। মুখ্য উদ্দেশ্য, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ থেকে বিরত রাখা। তবে এতেও যদি ইরানকে তার লক্ষ্য অর্জন থেকে বিরত না করা যায়, অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থান করতে শিখতে হবে। আফটার অল বিশ্বে ঘোষিত-অঘোষিত ডজনখানেকের ওপর পরমাণু অস্ত্র সজ্জিত দেশ রয়েছে।
কিন্তু সামরিক পদক্ষেপে সংশয়বাদীরা বুঝতে অক্ষম যে একটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত ইরান মধ্যপ্রাচ্যে এবং তা ছাড়িয়েও যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থ কতটা বিঘ্নিত করবে। এই সংশয়বাদীদের ভবিষ্যদ্বাণীতে এই ধারণাই সুপ্ত যে রোগের চেয়ে রোগমুক্তির প্রক্রিয়া অধিক বিপজ্জনক। যুক্তিবাদীরাও তাঁদের যুক্তিতে অনড়। তাঁদের মতে সত্য হচ্ছে এটাই যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাকে ধ্বংস করার নিমিত্তে সামরিক অভিযান যদি সযত্নে পরিচালিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়, সেই অর্জন শুধু একটি অঞ্চলকে নয়, সারা বিশ্বকে একটি সত্যিকারের আতঙ্ক থেকে বাঁচাতে পারে এবং নাটকীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদের ভিত্তিতে সুরক্ষা দিতে পারে।
অনেক বছরের আন্তর্জাতিক চাপ ইরানের পারমাণবিক লিপ্সার চেষ্টাকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। stuxnet নামের এক ধরনের কম্পিউটার কীট, যার নাকি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ হয়েছিল, তাতেই শুধু কিছু দিনের জন্য তেহরানের সমৃদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া স্থিমিত হয়েছিল, কিন্তু আইএইএ-র এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ভাইরাসে আক্রান্ত প্লান্টগুলো এখন সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসমুক্ত। আইএইএ-র সর্বশেষ ইরান সম্পর্কিত রিপোর্ট বিশ্বাস করতে বাধ্য করে এমন কিছু তথ্য তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র অবরোধ বা সাবোটাজ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে এবং এ পর্যায়ে পরমাণু অস্ত্রের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র পুনঃপরিকল্পনায় ব্যস্ত। দ্য ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অনুমান করে যে ইরান মনস্থির করার ছয় মাসের মধ্যে দেশের প্রথম পরমাণু অস্ত্রটি নির্মাণে সক্ষম। পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইরানের পরিকল্পনা মোতাবেক আরো নিরাপদ স্থাপনায় স্থানান্তরিত হলে সামরিক হামলায় তা ধ্বংস হওয়ার সম্ভাব্যতা অনেক কমে যাবে। আর যদি একটি দৃঢ় সংকল্প ইরান কোনো এক পর্যায়ে আইএইএ পরিদর্শকদের বিতাড়িত করা মনস্থ করে এবং অস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য (weapon grade) ইউরেনিয়ামের মজুদ বৃদ্ধি করেও ইরানের বেপরোয়া পরমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের আঁচ পাওয়া গেলে যুক্তরাষ্ট্রকে এখনি আঘাত হানতে হবে। এর পর ওয়াশিংটন আর কিছুতেই তেহরানকে নিউক্লিয়ার ক্লাবে যোগদান থেকে বিরত রাখতে পারবে না।
আঞ্চলিক কিছু রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটনের তেহরানকে বিরত রাখায় তার দৃঢ়তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে এবং তেহরানের আনুগত্য স্বীকারে না হোক ইরানের সঙ্গে জোট বাঁধার প্রবণতা প্রদর্শন করছে। অন্যরা তাদের নিজস্ব পারমাণবিক উদ্যোগে মন দিয়েছে, যাতে অন্তত ইরানি বোমার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। তেহরান যতই এফটি অস্ত্র নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ইরানবিরোধী, যথা ইরানের প্রতিবেশী আরব রাজতন্ত্রগুলো, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকির পরিমাণ বৃদ্ধিই পাচ্ছে। একটি পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত ইরান কালক্ষেপণ না করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে সংকুচিত করতে যাচ্ছে।
পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি পেছনে রেখে ইরান সহজেই যেকোনো মার্কিন রাজনৈতিক বা সামরিক উদ্যোগকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি পরমাণু যুদ্ধের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হবে এবং ওয়াশিংটনকে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একাধিকবার ভাবতে বাধ্য করবে। ইরানের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ সৌদি আরব সে ক্ষেত্রে সম্ভবত তার নিজস্ব পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকবে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যেও একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ইরান তার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে তার মিত্রদের পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে তাদেরও পরমাণু শক্তিতে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে পারে। পরমাণু অস্ত্রের পশ্চাৎ সমর্থনে প্রচলিত যুদ্ধের জন্য এবং এমনকি দমনমূলক কূটনীতির জন্য পরমাণু বোমা তার ধারকের জন্য বাড়তি শক্তির উৎসে পরিণত হবে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার অনেক সীমাবদ্ধতাই এখনকার রণাঙ্গনে নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিরোধক কার্যকর হওয়ার সুযোগ আছে।
তবে একটি পরমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত ইরান ইচ্ছে করেই একটি আত্মঘাতী পরমাণু যুদ্ধের সূচনা ঘটাবে না। কিন্তু ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উদ্বায়ী (volatile) পরমাণবিক ভারসাম্য হয়তোবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে সংকট সৃষ্টি করবে। এতে করে হয়তো এদের সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে যেতে পারে। ইরানের পরমাণু বিতর্কে উত্থিত নিরাপত্তা হুমকি ওয়াশিংটনকে বাধ্য করবে ইরানকে পরিবেষ্টন করার নীতিতে।
ইরানের হুমকি ঠেকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় স্থল ও নৌবাহিনীও মোতায়েন করতে হবে। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে, যার অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে ইরানের পরমাণু প্রযুক্তি স্থানান্তরের ওপর সতর্ক দৃষ্টি। এতদসত্ত্বেও বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে শেষ রক্ষা হওয়া কঠিন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএমএস
ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.