বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৯১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. জাহাঙ্গীর ওসমান, বীর প্রতীক সাহসী দলনেতা তীব্র শীত। সন্ধ্যা হতে হতেই চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। ঘোর অন্ধকার রাত। খালি চোখে দেড়-দুই হাত দূরেও কিছু চোখে পড়ে না।


এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিতে থাকলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলের নেতৃত্বে মো. জাহাঙ্গীর ওসমান।
মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আখাউড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে আক্রমণ চালাবেন। এ জন্য তাঁরা ওই এলাকা ঘিরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। মো. জাহাঙ্গীর ওসমান তাঁর দল নিয়ে মূল আক্রমণকারী দলের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর একটি দল অবস্থান নিল ভারতের আগরতলার উত্তর দিকে ধর্মঘরে, যাতে সিলেট থেকে মনতলা হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের আক্রমণ না করতে পারে।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম লক্ষ্য, আখাউড়াসংলগ্ন মিরাসানী, নিরানসানী, সিঙ্গারবিল রেলস্টেশন, রাজাপুর, আজমপুর দখল করা। এসব এলাকা আখাউড়া রেল জংশনসংলগ্ন। দুই ও তিন নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এসব জায়গা দখল করার জন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে আক্রমণ চালাবেন।
ঘোর অন্ধকার, কুয়াশা আর তীব্র শীত উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা মো. জাহাঙ্গীর ওসমানের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অবস্থানের ওপর। গোলাগুলিতে গোটা এলাকা প্রকম্পিত। চারদিকে বারুদের গন্ধ। গোলাগুলির আলোয় আকাশ লালবর্ণ ধারণ করল।
মো. জাহাঙ্গীর ওসমান সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে পর্যুদস্ত করে ফেললেন পাকিস্তানি সেনাদের। তাঁদের সাহসিকতায় পাকিস্তানিরা হতোদ্যম হয়ে পড়ল। একটু পর তারা পালাতে শুরু করল। এর মধ্যে হতাহত হয়েছে অনেক পাকিস্তানি সেনা। নিহত ও আহতদের ফেলেই পাকিস্তানিরা পশ্চাদপসরণ করল।
পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনারা সাময়িকভাবে পিছু হটলেও পরের দিন পুনর্গঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালাল। মো. জাহাঙ্গীর ওসমানের মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে থাকলেন। খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করল। বৃষ্টির মতো ছিল সেই গোলাবর্ষণ। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ বেকায়দায় পড়ে গেলেন। গোলার আঘাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকল বেশ। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হলেন। মো. জাহাঙ্গীর ওসমান এতে দমে যাননি। পরের দিন সহযোদ্ধাদের পুনর্গঠিত করে আবার আক্রমণ চালান পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তুমুল যুদ্ধে জয়ী হন তাঁরাই।
এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। সেখানে নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপুল শক্তি। কয়েক দিনের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী গোটা আখাউড়া এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়।
মো. জাহাঙ্গীর ওসমান ১৯৭১ সালে পড়াশোনার পাশাপাশি যুব রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা (তখন মহকুমা) ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যাওয়ার পর সীমান্ত এলাকায় ছোটখাটো কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। এরপর তিনি অন্তর্ভুক্ত হন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য গঠিত প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে ২ নম্বর সেক্টরে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২ নম্বর সেক্টরের একটি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. জাহাঙ্গীর ওসমান বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪২। তাঁর প্রকৃত নাম মো. জাহাঙ্গীর ওসমান ভূঁইয়া।
মো. জাহাঙ্গীর ওসমান ২০০২ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নের ছতরা শরীফ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মকবুলুর রহমান ভূঁইয়া, মা দেলোয়ারা বেগম। স্ত্রী সেলিনা আক্তার, তাঁদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন।
সূত্র: প্রথম আলোর কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি মো. সোহরাব হোসেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.