সাঈদের পরিবার বলছে এটা হত্যাকাণ্ড-রশি ও পলিথিনের উৎস খোঁজা হচ্ছে by সাহাদাত হোসেন পরশ ও ইন্দ্রজিৎ সরকার

কারা হেফাজতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাঈদের মৃত্যুরহস্যের জট এখনও খোলেনি। তবে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলের ১১ কারারক্ষীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পাটের রশি ও একটি পলিথিনের ব্যাগ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রিজন সেলের ভেতর ওই রশি ও পলিথিনের ব্যাগ কীভাবে এলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।


এদিকে কারা হেফাজতে সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। রুমানার পরিবারই কৌশলে এ
ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তারা মনে করেন। তাদের অভিযোগ, কারা কর্তৃপক্ষও সাঈদের মৃত্যু নিয়ে লুকোচুরি করছে। তারা এ ব্যাপারে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
স্ত্রীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার সাঈদ ২৩ নভেম্বর থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সোমবার ভোর ৪টার দিকে সেখানকার বাথরুম থেকে কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় সাঈদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় তার দু'হাতের কব্জিতে কালো দাগ ছিল। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে।
শাহবাগ থানার ওসি রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, প্রিজন সেল থেকে একখণ্ড পাটের রশি ও একটি পলিথিনের ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ঘটনাটি হত্যা, আত্মহত্যা, নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু, তা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ছাড়া বলা যাবে না। রশি ও পলিথিনের উৎস খোঁজা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, লাশ উদ্ধারের সময় সাঈদের হাত রশি দিয়ে বাঁধা ছিল বলে জানিয়েছে কারারক্ষীরা। এ কারণে তার হাতের কব্জিতে কালো দাগ দেখা গেছে। হাত বাঁধার কাজে ব্যবহৃত রশিটিই পুলিশ উদ্ধার করেছে। এটির দৈর্ঘ্য বেশি নয়, তবে দু'হাত বাঁধার পক্ষে যথেষ্ট। আর পলিথিনের ব্যাগটি দিয়ে সাঈদের মাথা ও মুখমণ্ডল ঢাকা ছিল। পলিথিন দিয়ে শ্বাসরোধের ফলে তার মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রিজন সেলে রশি বা পলিথিন থাকার কথা নয়। ১৫ জন নিরাপত্তাকর্মী থাকার পরও কীভাবে রশি-পলিথিন সেখানে গেল_ এটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার আলতাফ হোসেন সমকালকে বলেন, ঘটনার সময় প্রিজন সেলে কর্তব্যরত প্রধান কারারক্ষী হাবিলদার সিরাজ সর্দারসহ ১১ কারারক্ষীকে গতকাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হতে পারে।
কারা সূত্র জানায়, সাঈদের সঙ্গে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন বিজিবি জওয়ান ইউসুফ ও সন্ত্রাসী অপুর সে রাতের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে হাবিলদার সিরাজ সর্দারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিনি অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন আসামিদের সঙ্গে স্বজনদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি বন্দি সন্ত্রাসীর সঙ্গে তার সহযোগীদের কথা বলার সুযোগও করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে মৃতের ছোট ভাই ফারুক সাঈদ শাওন অভিযোগ করেন, কারা হেফাজতে কৌশলে তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যু নিয়ে লুকোচুরি করছে। সাঈদের মৃত্যুর পর জেলার তাদের ফোন করে বলেন, বাথরুমে লুঙ্গি পরা অবস্থায় তার লাশ পড়েছিল। অথচ তারা যখন দেখলেন তখন সাঈদের পরনে ছিল খাকি প্যান্ট; কিন্তু সাঈদ সবসময় লুঙ্গি পরেই ঘুমাতেন। পাশাপাশি তারা জেনেছেন, বিএসএমএমইউ প্রিজন সেলের সুপারিনটেনডেন্ট জামাল উদ্দিন আহমেদ রোববার রাত আড়াইটার দিকে সেখানে ঢোকেন। তিনি প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন। এর কিছু সময় পরই সাঈদের লাশ পাওয়া যাওয়ায় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কারা আইন অনুযায়ী গভীর রাতে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া প্রিজন সেলে কারও প্রবেশের অনুমতি নেই।
ফারুক বলেন, রুমানার সঙ্গে ইরানি যুবক নাভিদ তাহের বিনের সম্পর্কের বিষয়টি প্রমাণিত। প্রায় ১০ বছরের ছোট নাভিদের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। এর সপক্ষে প্রচুর ই-মেইল ও ছবি তাদের হাতে রয়েছে। সেসব ছবি রুমানার বেপরোয়া জীবনযাপন এবং নাভিদের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সাক্ষ্য দেয়। নাভিদকে পাঠানো ই-মেইলগুলো দেখলে তার নোংরা মানসিকতা স্পষ্ট হয়। সেখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা লোকজনের সামনে উচ্চারণ করার মতো নয়।
ফারুকের অভিযোগ, রুমানার চোখ নষ্ট হয়নি। তিনি অন্ধের অভিনয় করে যাচ্ছেন। এখনও তারা ডিবি পুলিশের কাছে রুমানার চোখ নষ্টের কোনো প্রমাণ (কাগজপত্র) দিতে পারেননি। এ জন্য তারা কৌশলে সাঈদকে হত্যা করিয়েছে।
সাঈদের মা হাসিনা আহমেদ কবীর সাংবাদিকদের বলেন, এর আগেও তার ছেলেকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তখন স্ত্রী রুমানা মঞ্জুর তাকে হত্যার জন্য বেলের শরবতের সঙ্গে ১১০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছিল। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এ ব্যাপারে প্রমাণ মিললে হত্যা মামলা করা হবে। গতকাল বাদ জোহর রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে সাঈদের লাশ দাফন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর ৫ জুন রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসায় সাঈদের নির্যাতনের শিকার হন। এ ঘটনার পরদিন রুমানাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে তার বাবা মনজুর হোসেন বাদী হয়ে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন। এরপর ১৫ জুন সাঈদকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেদিন দুপুরেই ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি) রাজধানীর উত্তর মুগদার একটি বাসা থেকে সাঈদকে গ্রেফতার করে। পরে সাঈদকে চার দফায় ছয় দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। তার জামিনের জন্য চারবার আবেদন করা হলেও আদালত তা নাকচ করে দেন। এদিকে ১৫ জুলাই কানাডার ভ্যানকুভার জেনারেল হাসপাতালে রুমানার চোখে অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা জানান, 'তিনি আর কোনোদিনই দেখতে পাবেন না।' আদালতে এখন এ সংক্রান্ত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) পেশ করা হবে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.