মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-বিচার দাবিতে লাখো মানুষের মানববন্ধন-মন্ত্রী রাজুর অপসারণ দাবি

রসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের বিচারের দাবিতে গতকাল বুধবার লাখো মানুষ ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করেছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর মাধবদী থেকে শিবপুরের ইটাখোলা পর্যন্ত এ মানববন্ধন হয়েছে।নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ডাকে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ পেশাজীবীরা অংশ নেন।


মানববন্ধনে মেয়র লোকমান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য প্রধান আসামি সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর ভাই ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর অপসারণ দাবি করা হয়।
সকাল ১১টায় মানববন্ধন শুরু হলেও সকাল ১০টা থেকে নরসিংদী সদরসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিভিন্ন সংগঠন মিছিল নিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জমায়েত হতে শুরু করে। পাশাপাশি মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে পাশের গ্রাম থেকে লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধনে যোগ দিয়ে মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকারীদের বিচারের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। মানববন্ধনের কারণে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ওই সময় যানবাহনগুলো ধীরে ধীরে চলাচল করলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নরসিংদীর মাধবদী বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মানববন্ধনে অংশ নেয়। তারা বিভিন্ন স্লোগান-সংবলিত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড বহন করে। পাশাপাশি শতাধিক বাস ও যাত্রীবাহী পিকআপ এবং হাজারো মোটরসাইকেল নিয়ে মানববন্ধন এলাকা প্রদক্ষিণ ও মিছিল করে বিক্ষোভকারীরা। ওই সব মিছিল থেকে মেয়র লোকমান হত্যার ঘটনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু ও তাঁর ভাই লোকমান হত্যা মামলার প্রধান আসামি সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করে। পরে ভেলানগর এলাকায় মন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করে তারা।
মানববন্ধনে অংশ নেন সদর আসনের সংসদ সদস্য লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হীরু (বীরপ্রতীক), জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভুঁইয়া, নিহত লোকমান হোসেনের মা মাজেদা বেগম, স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলী, ছোট ভাই মামলার বাদী কামরুজ্জামান, ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ, মাধবদী পৌর মেয়র হাজি মো. ইলিয়াছ, নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক, আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ড. মশিউর রহমান মৃধাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া বাসাইল এলাকার গৃহবধূ ফরিদা, কামরুন নাহার ও শিউলি বলেন, 'মেয়র লোকমান শুধু উন্নয়নই করেননি, তিনি সন্ত্রাস ও মাদক দূর করে নরসিংদীকে করেছিলেন শান্তির শহর। সেই মানুষটিকে যারা মেরে ফেলেছে আমরা তাদের ফাঁসি চাই।'
মানববন্ধন চলাকালে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে লোকমান হোসেনের মা মাজেদা বেগম বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমি সন্তান হত্যার বিচার চাই। ওনি (প্রধানমন্ত্রী) যেন এই হত্যার সঠিক বিচার করেন যা দেখে দেশবাসী স্বস্তি পায়, এই আমার দাবি। ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখার জন্যই আমি বেঁচে থাকব। তা না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না।'
লোকমান হোসেনের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলী বলেন, 'রাজু মন্ত্রীর অপসারণ না হলে মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যার নিরপেক্ষ বিচার বাধাগ্রস্ত হবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের পরিবারসহ নরসিংদীবাসীর দাবি, রাজু মন্ত্রীর অপসারণ এবং মেয়র হত্যার পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের ফাঁসি। যদি শিগগিরই এ দাবিগুলো মানা না হয় তাহলে নরসিংদীর সাধারণ জনগণকে নিয়ে আমরা কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় নামব।'
মামলার বাদী কামরুজ্জামান বলেন, 'ভাইয়ের খুনিরা গ্রেপ্তার হয়েছে তাঁদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে_এ সংবাদ শোনার অপেক্ষায় প্রতিটি দিন কাটে আমার। কিন্তু প্রতিদিনই কাটছে আমাদের হতাশার মধ্যে। কারণ ঘটনার এক মাসের অধিক সময় পার হলেও পুলিশ হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে গড়িমসি করছে। তাই আমাদের পরিবার এমনকি নরসিংদীবাসীর ধারণা, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী বহাল থাকায় তিনি হত্যার ঘটনা তদন্ত ও আসামিদের গ্রেপ্তারে প্রভাবিত করছেন।'
তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য : এদিকে মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদীর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চায়। তাই আমরাও প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য। এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি, বাকিদের গ্রেপ্তারে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু আসামিরা ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করায় তাঁদের গ্রেপ্তারে বিলম্ব হচ্ছে।'
গত ১ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন নরসিংদীর পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন।

No comments

Powered by Blogger.