সন্তান সবই সমান কাজেই... by মেহেরুননেছা রুমা

দীপার বাবা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে অনেক বছর আগে ঢাকা এসেছিলেন প্রায় শূন্যহাতে। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গায়ের রক্ত পানি করে ঢাকার লালবাগ এলাকায় নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করান। সেখান থেকে ধীরে ধীরে তিনি অনেক বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। আর লালবাগে অনেক জায়গাজমি কিনে বাড়িঘর তৈরি করে সেই এলাকাতেই দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। একমাত্র মেয়ে দীপা আর পাঁচ ছেলের সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত।


এদের মধ্যে দীপা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। পাঁচ ছেলের মধ্যে কেউ বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেন, আবার কেউ যার যার মতো করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দীপার বাবা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর কিছুদিন আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
দীপার বাবা মৃত্যুর আগে তার ব্যবসা এবং সহায় সম্পত্তি ছেলেমেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যান। তবে তিনি মেয়েকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। আইন অনুযায়ী দীপা যা পাওয়ার কথা তার চেয়ে অনেক কমই বাবা তাকে দিয়েছেন। তবে এই নিয়ে দীপার কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি বাবাকে অনেক ভালোবাসতেন। মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং সন্তানদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কোটি কোটি টাকার সম্পদ করে গেলেও মৃত্যুর আগে তাকে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় এবং অযত্ন-অবহেলায় জীবনের শেষ দিনগুলো পার করতে হয়েছে। ছেলেরা সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অসুস্থ বাবাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি ধনাঢ্য ছেলেরা। যাদের জন্য সবকিছু করেছেন, যে পুত্র সন্তানদের সবকিছু দিয়ে গেছেন, সেই সন্তানরা মৃত্যুপথযাত্রী বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন করেননি।
দীপা তার চাকরির টাকা দিয়ে যতটা সম্ভব বাবার চিকিৎসা করিয়েছেন। প্রতিদিন গিয়ে অসুস্থ বাবার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনার পরশ দিয়ে বলেছেন, বাবা, আমি তোমার মেয়ে, তোমার পাশে আছি, তুমি ভেব না । একদিন তুমি অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠবে, আবার তোমার ব্যবসা দেখতে পারবে। বাবার জটিল অসুখের পেছনে মেয়ে দীপা তার প্রায় সব সঞ্চিত অর্থই খরচ করে ফেলেছিলেন। তবুও যদি বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু বাবা আর সুস্থ হননি। ঠিকই একমাত্র কন্যাকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। বাবার শেষকৃত্য সম্পাদন করতে ছেলেরা ঠিকই এসেছিলেন সেদিন। আর ধনাঢ্য সন্তানদের বাবার মৃত্যুপরবর্তী কুলখানিটা করেছিল বেশ জমজমাট করেই। শত হলেও সমাজে তাদের নাম-ডাক আছে।
একই বাবার সন্তান দীপা আর তার পাঁচ ভাই। অথচ বাবার সম্পদের বেশিরভাগই পেলেন ভাইয়েরা। একমাত্র কন্যা দীপা যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক কম পেয়েছেন। অথচ সেই দীপাই বাবাকে ছেড়ে যেতে পারেননি। ভাইয়েরা যখন বাবার খোঁজ নেননি, দীপা তখন বাবার পাশে এক আদর্শ সন্তানের কর্তব্য পালনে একদিকে অর্থ দিয়ে, অন্যদিকে সেবা দিয়ে বাবাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। কী পেল না পেল সেটা তার মনে আসেনি। মেয়েরা সাধারণত এমনই হয়। বাবা-মায়ের প্রতি তাদের ভলোবাসাই বেশি_ দীপা এই কথাটিই প্রমাণ করলেন। দীপা বলেন, ভাগ্যিস আমার একটা রোজগারের উপায় ছিল! না হলে কী দিয়ে বাবার চিকিৎসা করাতাম? চোখের সামনে বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন_ সন্তান হয়ে আমি কীভাবে তা সহ্য করব? তবুও দীপার আক্ষেপ, বাবার উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। আরও উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে বাবা হয়তো সেরে উঠতেন। কিন্তু তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। আর সেটা দীপার ছিল না। যাদের কাছে টাকা ছিল তারা সামান্য দায়িত্বটুকুও পালন করল না। বাবার সম্পদেই তারা বড় হলো, অথচ উন্নত চিকিৎসার অভাবে বাবাকে সময়ের অনেক আগেই চলে যেতে হলো। এমন অনেক দীপা আছেন আমাদের সমাজে। যারা শুধু কন্যাসন্তান নয়; শুধু 'সন্তান' হয়ে একটু সুযোগ পেলেই বাবা-মাকে সব উজাড় করে দিতে কোনো কার্পণ্য করেন না।
অথচ সেই কন্যাসন্তানকে সম্পত্তিতে বঞ্চিত করা হয়। আইনানুযায়ী যতটুকু সে প্রাপ্য ততটুকু থেকেও বঞ্চিত করা হয় অধিকাংশ মেয়েকে! আধুনিক এ সময়েও কি মেয়েরা এভাবে বঞ্চিত হবে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে? কবে বিশেষ করে বাবাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে কন্যাসন্তানের প্রতি সত্য হচ্ছে, এখনও অনেক বাবাই কন্যা সন্তানের প্রতি অবজ্ঞা শুধু নয়, কন্যা সন্তানই চান না তারা। ছেলেদেরই আশ্রয় মনে করেন তারা। কবে তারা ভাববেন ছেলেমেয়ে উভয়েই সমান, আইনের চেয়েও যে জরুরি এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
 

No comments

Powered by Blogger.