'ডাকলে আসবো ডাকলে যেও' by অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

থিয়েটার প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পদক ২০১১ নিতে এক ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের অধ্যাপক, নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা মনোজ মিত্র। কর্মময় ব্যস্ততার মধ্যেও নন্দনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন দুই বাংলার দুই নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র ও ফেরদৌসী মজুমদার। নন্দনের পাঠকদের জন্য রইল তাদের কথোপকথন।


ফেরদৌসী মজুমদার : মনোজ দা, কীভাবে শুরু করি বলেন তো? কোথা থেকে শুরু করব ভেবেই পাচ্ছি না!
মনোজ মিত্র : এত ভেব না। যদিও লেখার প্রথম লাইনটা, বলার প্রথম বাক্যের পেছনে লুকিয়ে থাকে হাজারটা ভাবনা। তবুও তুমি একটা কিছু প্রশ্ন করো, দেখবে আলাপচারিতা গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলছে।
ফেরদৌসী মজুমদার : দাদা আপনি তো এবার থিয়েটার প্রবর্তিত মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পদক ২০১১ পেলেন। এ পুরস্কার প্রাপ্তিটাকে কীভাবে দেখছেন?
মনোজ মিত্র : এই পদক গলায় নিয়ে আমি পরম সুখী এবং অভিভূত। একজন মানুষ তার জীবনের অনেক অধ্যায় হয়তো ভুললেও ভুলে যেতে পারে। কিন্তু সে যেটা ভোলে না, যেটা তার স্মৃতিতে বারবার ফিরে আসে, তা হলো তার শৈশব। আমার জন্মস্থান সাতক্ষীরা জেলায়। শৈশবের কিছুটা সময়ও কেটেছে এখানে। আমি যে আজ সেই দেশ থেকে সম্মান পেলাম তার মূলে থিয়েটার। নাট্যচর্চা করাটা আজ সার্থক হলো। থিয়েটারের ডানায় ভর করে আজ আবারও এখানে আসতে পারলাম। এই সম্মাননা আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটি হলো পদকটি অধ্যাপক চিন্তাবিদ নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর নামাঙ্কিত। বাংলাদেশে তার অবস্থান অতি উঁচুতে। ভারতেও তার মনীষা, শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতে সুপরিচিত। আমরা অবিভক্ত বঙ্গদেশে গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত দেখিনি। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুনীর চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানবিরোধী থিয়েটারের স্বপ্ন দেখা, নতুন থিয়েটারের ভাবনা, ছাত্র-সমাজের মধ্যে নাটক ও নাট্যের চেতনা সৃষ্টি করা, একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে কারাবরণ করা প্রভৃতি আমরা কৌতূহল ভরে দেখছি। তেজোদীপ্ত পদচারণা দেখে আমরা উৎসাহ পাচ্ছি, অনুপ্রেরিত হচ্ছি। এক সময় যার কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছি আজ সেই মুনীর চৌধুরীর নামাঙ্কিত সম্মাননা পদক গলায় পরতে পেরে আমি সবিশেষ গর্বিত।
ফেরদৌসী মজুমদার : গর্বের জায়গাটা আমারও। আমি এই মুনীর চৌধুরীর বোন। তিনি আমার বড় ভাই। আচ্ছা দাদা, আপনার রচিত, নির্দেশিত, অভিনীত এবং আপনাদের নাট্যদল সুন্দরম প্রযোজিত নাটক 'সাজানো বাগান' বার্ষিক বিরতিহীনভাবে টানা ৪৪ বছর মঞ্চায়িত হয়ে চলেছে। এটা কীভাবে করতে পারলেন?
মনোজ মিত্র : আমরা যে এতটা বছর ধরে নাটকটি করছি বা করতে পারলাম তার মূলে দর্শকদের চাওয়া। মানুষ চায় নাটকটি দেখতে। যে কোনো আমন্ত্রক গোষ্ঠী এসে বলে, 'সাজানো বাগান' আমাদের ওখানে অন্তত একবার হলেও প্রদর্শন করুন, শেষবারের মতো অনুরোধ। এখন সবাই যদি শেষবারের প্রদর্শনের জন্য শেষ অনুরোধ জানায় তাহলে অনুরোধ রক্ষা করতে করতে শেষের সেদিন আসতে তো একটু দেরিই হবে। তাই না? আচ্ছা ফেরদৌসী, তোমার মঞ্চ কাঁপানো 'কোকিলারা' নাটকের অভিনয় সেই '৮৪তে কলকাতাতে দেখেছি। শুনলাম এবার ঢাকার মহিলা সমিতির ভাঙা-গড়া উৎসবে আবার করলে। মধ্যবর্তী সময় তুমি অভিনয় চলা অবস্থায় অসুস্থ হলে। সুস্থ হয়ে পুনঃঅভিনয় করার পর এই প্রজন্ম তোমার 'কোকিলারা'র অভিনয় কীভাবে নিলো?
ফেরদৌসী মজুমদার : 'কোকিলারা' নাটকটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। মাঝে অসুস্থজনিত কারণে অভিনয় করতে না পেরে আমি অত্যন্ত বিমর্ষ ছিলাম। প্রখ্যাত নাট্যকার অভিনেতা নির্দেশক প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন এই নাটকটি করায় আমাকে সাহস এবং আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছেন। সেই ভরসাতেই আমি এতদিন পর কোকিলারা করলাম এবং এই প্রজন্মের দর্শকের চোখে-মুখে তৃপ্তি-প্রশান্তির আভাস পেলাম। আমি ধন্য। আমার অভিনয়জীবন ধন্য হলো, সার্থক হলো।
মনোজ মিত্র : ফেরদৌসী, তুমি তো শুধু এ দেশের অভিনেত্রী নয়। তোমার একটা উভয় বাংলায় বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। অভিনেত্রী জীবনের এ অর্জনটা তোমার কাছে ঠিক কেমন?
ফেরদৌসী মজুমদার : এ আমার পরম প্রাপ্তি।
মনোজ মিত্র : আমার কাজকে তুমি কীভাবে দেখ?
ফেরদৌসী মজুমদার : যেদিন থেকে আপনাকে চিনি সেদিন থেকেই আপনার কাজে এবং গুণে আমি মুগ্ধ। এবার আপনার সঙ্গে আপনার চমৎকার পাণ্ডুলিপিতে অভিনয় করে আমি আনন্দিত।
মনোজ মিত্র : 'দম্পতি' নাটকটি লিখার সুবাদে অভিনয়ের একটা পূর্বপ্রস্তুতি আমার ছিল। কিন্তু তুমি স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে একবেলার মধ্যে মঞ্চে সরাসরি নাট্যাভিনয়ে অংশ নিয়ে দর্শকদের বিমোহিত করলে। এত দ্রুত কীভাবে করলে বল তো?
ফেরদৌসী মজুমদার : দর্শক বিমোহিত হয়েছে কি-না কিংবা করতে পেরেছি কি-না সে ব্যাপারটা বলতে পারব না দাদা। তবে ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে আমার সত্যি ভালো লাগে। আর সহশিল্পী যখন আপনার মতো ব্যক্তিত্ব, তখন সেখানে ভাবার আর কী অবকাশ থাকে! আচ্ছা মনোজ দা, আপনি যেদিন আমার 'কোকিলারা' অভিনয় দেখেছিলেন সেদিনের কথা কি কিছু মনে পড়ে?
মনোজ মিত্র : মনে পড়বে না মানে, নিশ্চয়ই মনে পড়ে। 'কোকিলারা' দেখেছিলাম, হয়তো তারও আগে দেখেছিলাম 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়'। তোমার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা জানিয়েছিলাম আমার বন্ধু, চিত্রপরিচালক তপন সিংহকে। আমার কথা শুনে তিনি তার একটি চলচ্চিত্রে তোমাকে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরে তিনি অসুস্থ হলে কাজটি আর এগোয়নি।
ফেরদৌসী মজুমদার : মনোজ দা, আপনি তো মঞ্চ-চলচ্চিত্র-বেতার-দূরদর্শন সব মাধ্যমে কাজ করেছেন। আপনার উপলব্ধি কী?
মনোজ মিত্র : মঞ্চের মাধ্যমে পেয়েছি স্বাচ্ছন্দ্য, চলচ্চিত্রে আনন্দ, বেতারে বাড়তি আর দূরদর্শনে দুর্গতি। এ আমার একান্ত নিজস্ব উপলব্ধি। তা ফেরদৌসী, তুমি যেখানে শিক্ষকতা কর সেই
সানবিমস বিদ্যালয়ে রবিঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নির্দেশনা দিলে নাটক মুকুট। নির্দেশনা নিয়ে কিছু বল।
ফেরদৌসী মজুমদার : আমার নিজের সাহস হতো না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক 'মুকুট' করা, এই নবিশ স্কুল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। সবটাই সম্ভব হয়েছে সানবিমসের অধ্যক্ষ মনজুরের উৎসাহে। আমি আমার সর্বোচ্চ শ্রম ও আশা নিয়ে নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি এবং পরিশেষে মঞ্চস্থও হয়েছে। দাদা, আপনি তো নাটক, রচনা-নির্দেশনা এবং অভিনয় তিনটি কাজই সমান তালে করে চলেছেন। এই তিন কাজের তিনটি উপলব্ধি যদি বলেন!
মনোজ মিত্র : আমি সবচেয়ে নিজেকে খুঁজে পাই নাটক রচনায়, আবিষ্কার করি অভিনয়ে এবং ক্লান্তবোধ করি নাটকের নির্দেশনায়।
ফেরদৌসী মজুমদার : মনোজ দা, অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে আমাদের একটা প্রস্তুতি রাখতেই হয়। কিন্তু একজন নাট্যকার হিসেবে আপনার প্রস্তুতিটা ঠিক কী রকম।
মনোজ মিত্র : কোনো বিশেষ সময়ের প্রস্তুতি নেওয়া নয়। এই প্রস্তুতি চলতেই থাকে চেতনে কিংবা অবচেতনে। এর প্রমাণ, যে কোনো মুহূর্তে একজন নাট্যকার নাটক রচনা শুরু করতে পারেন।
ফেরদৌসী মজুমদার :মনোজ দা, আপনার কি মনে হয় মঞ্চ নাটকে পেশাদারিত্ব হওয়া সম্ভব!
মনোজ মিত্র : পেশাদারিত্ব হওয়া উচিত, নইলে কাজটিও ভালো হয় না আবার মানুষটিও টিকে থাকে না। আচ্ছা ফেরদৌসী, আমার বন্ধু নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের অবর্তমানে রামেন্দুর কাজের চাপ শতগুণে বেড়ে গেছে। তোমরা দু'জনে মিলে থিয়েটার দলকে কীভাবে সামলাচ্ছ?
ফেরদৌসী মজুমদার : তার চলে যাওয়াটা আমাদের কাছে গভীর বেদনার এবং শূন্যতার। তা সত্ত্বেও তাকে এবং তার কাজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বটাও আমাদের। সে কথা মনে রেখেই আমরা থিয়েটারকে সচল করে রাখছি।
মনোজ মিত্র : জান ফেরদৌসী, থিয়েটারের মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পদক পাওয়ার পর থেকে কেন জানি মনে হচ্ছে দায়িত্বটা আমার আরও বেড়ে গেল। তোমার বড় ভাই কবীর চৌধুরীর মঞ্চে সেদিনের তেজোদীপ্ত উপস্থিতি দেখে বুঝেছি মানুষ চাইলে আমৃত্যু কাজ করে যেতে পারেন। তাকে দেখেও আমি অনুপ্রাণিত হলাম।
ফেরদৌসী মজুমদার : জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী আমাদের জন্য আদর্শ ব্যক্তি এবং তার জীবন-পদ্ধতি অবশ্যই অনুকরণীয়। তিনি আরও সচল ও সুস্থ থাকুন এই কামনা সতত।
তিনি আমার বড় ভাই, রক্তের বন্ধন। আবার নাট্যকর্ম সুবাদে আপনার সঙ্গে আমাদের আত্মার বন্ধন। এখন এ দু'জনের একজন যদি অন্যজন দ্বারা অনুপ্রাণিত হন তবে নিকটাত্মীয় হিসেবে আমার মতো গর্ব আর কার হতে পারে বলেন দাদা।
মনোজ মিত্র : তা ফেরদৌসী ত্রপার অভিনয় কবে দেখব।
ফেরদৌসী মজুমদার : ওর বাবাকে বলব ব্যবস্থা নিতে। মনোজ দা এবার গেলে আবার কবে আসবেন।
মনোজ মিত্র :ডাকলেই আসব। তোমাদের ডাকলেও যেও।

No comments

Powered by Blogger.