শেয়ারবাজার-এক বছরে এক লাখ কোটি টাকার মূলধন নেই by নাজমুল আলম শিশির

পুঁজিবাজারে ধসের আলামত প্রথম দেখা গিয়েছিল ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর। সেদিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ছিল ৮৯১৮.৫১ পয়েন্ট। দুই দিন পর ৭ ডিসেম্বর সূচক ৩৩২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছিল ৮৫৮৬ পয়েন্টে। এর ঠিক এক বছর পর গতকাল বুধবার মূল্যসূচক থেমেছে ৫০৩১ পয়েন্টে। এক বছর আগে এই দিনে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৫০ কোটি টাকা। আর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ৫৬ হাজার ৭০১


কোটি টাকা। অন্যদিকে গতকাল লেনদেন ছিল ২৭৪ কোটি টাকা, আর বাজার মূলধন দুই লাখ ৫২ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে মূল্যসূচক কমেছে ৩৫৫৫ পয়েন্ট, লেনদেন নেমেছে সাত ভাগের এক ভাগে। আর বাজার থেকে হারিয়ে গেছে এক লাখ তিন হাজার ৭৫৪ কোটি টাকার মূলধন।
পুঁজিবাজারের এ বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের নানামুখী উদ্যোগ আর সর্বশেষ এসইসির গুচ্ছ ঘোষণার পরও চলছে দরপতন। আগের দুই দিনের মতো গতকালও ডিএসইতে সূচক কমেছে। মতিঝিলের রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ। এমদাদ হোসেন নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, এক বছর ধরে শেয়ারবাজারে দরপতন চলছে। আশায় ছিলাম বাজার হয়তো স্থিতিশীল হয়ে যাবে। কিন্তু এখন পতন হতে হতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ বাজারের প্রতি আর কোনো আশা-ভরসা নেই।
গতকাল ডিএসইর সাধারণ মূল্য সূচক আগের দিনের চেয়ে ২০ পয়েন্ট কমেছে। লেনদেন হওয়া ২৫৪টি কম্পানির মধ্যে ১২২টির দরই কমেছে। বেড়েছে ১১৩টির। আশাহত বিনিয়োগকারীদের একটি দল দুপুর ১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ করে।
মনিরুজ্জামান নামের এক বিনিয়োগকারী আক্ষেপ করে বলেন, বাজার হয়তো আর ঠিক হবে না। কত কী তো করা হলো, তার পরও তো কিছু হচ্ছে না। তিনি বলেন, যতই আন্দোলন হোক, বিক্ষোভ হোক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না এলে বাজার চাঙ্গা হবে না। আর আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারী তো বাজার থেকে বের হতেও পারছি না। নতুন করে যে আবারও বিনিয়োগ করব, সে উপায়ও নেই।'
বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন মাহমুদ হোসেন নামের এক বিনিয়োগকারী। তিনি বলেন, সরকার যত কথাই বলুক না কেন, লোকসান দিতে কে আসবে এ বাজারে। ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের কথা বলা হলেও তারাও হয়তো নানা হিসাব-নিকাশ করছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, 'ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিরাস হয়ে পড়েছে। এখন বড় আকারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ করে সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই সাপোর্ট দেওয়া হবে কি না সেটাই এখন প্রশ্ন।' এক বছরের পতন সম্পর্কে তিনি বলেন, বাজার থেকে অনেক টাকা বের হয়ে গেছে। ফলে বাজারে কোনো ক্রেতা নেই। যারা আছে তারাও লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না। শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও চলে গেছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণেই বাজার ঠিক হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার ধসের কারণ অনুসন্ধানে সরকারের গঠন করা তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রথমেই যদি দোষীদের শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো বাজারে এত পতন হতো না। শেয়ারবাজার আস্থার ওপর নির্ভর করে। আস্থা না থাকলে মানুষ এখানে বিনিয়োগে আসবে না।
চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) সাবেক সভাপতি ফখর উদ্দিন আলি আহমদ বলেন, 'একটি অতি মূল্যায়িত বাজার পতনের পর ঠিক হতে কিছু সময় লাগে। গত একটি বছর শেয়ারবাজারের ক্রান্তিকাল গেছে। শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারী নয়, স্টক ব্রোকার, এসইসিসহ সরকারের নানা মহলকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর পরও আমি আশা করছি, এখন বাজার স্থিতিশীল হওয়ার সময় এসেছে। আস্তে আস্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। তার জন্য হয়তো কিছু সময় লাগবে।'

No comments

Powered by Blogger.