পুনর্বার পাটের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা by ইফতেখার আহমেদ টিপু

সোনালি আঁশ পাটের বাজারে চলছে ভয়াবহ মন্দা। কৃষকরা যে দামে পাট বিক্রি করছে, তাতে তাদের উৎপাদন খরচ উঠে আসছে না। একসময়ের আমাদের গর্ব সোনালি আঁশ তাদের গলার ফাঁস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পাটকলগুলো পাট কেনা কমিয়ে দিয়েছে। রপ্তানির মাত্রা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই এখন পর্যন্ত। রপ্তানিকারকরা পাট কিনতে চাইছে না আগের মতো। কমে গেছে বিশ্ববাজারেও পাটের চাহিদা। পাটচাষ ও পাটের


যথাযথ ব্যবহার_এ দুটি বিষয়েই দীর্ঘ সময় ধরে চলছে সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড। ইউরোপসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যে পাট রপ্তানি হতো, তার পরিমাণ কমে গেছে সেখানকার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। বিশ্বমন্দার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। রপ্তানিকারকরা গুদামে পাটের স্তূপ নিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। পরিণতিতে দেশীয় বাজারে পাটের দাম ক্রমান্বয়ে কমছে। গত দুই বছর সন্তোষজনক দাম পাওয়ায় চাষিরা এবার বেশি জমিতে পাটের চাষ করায় উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু দাম অর্ধেকে নেমে আসায় বাড়তি উৎপাদন আশীর্বাদের বদলে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। গত বছর নিম্নমানের পাটের মণ যে ক্ষেত্রে ছিল দেড় থেকে দুই হাজার টাকা, দুই মাস ধরে দাম কমতে কমতে তা ৭০০ টাকায় এসেছে। সবচেয়ে ভালো মানের পাটের দর তিন হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকা। সাধারণত নিম্নমানের পাট দিয়ে চটের ব্যাগ তৈরি হয় এবং বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি) এ ধরনের পাটই বেশি কেনে। এ বছর তারা নিম্নমানের পাটের চেয়ে উন্নতমানের পাট বেশি কিনেছে। এখন সেই পাট বিক্রি করতে পারছে না সংস্থাটি। সরকারি পাটকলগুলোতে বর্তমানে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার পাট পড়ে আছে। উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা না থাকায় পাটকলগুলো চালু রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিম্নমানের পাটের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বিজেএমসি এ বছর বেশি দাম দিয়ে উন্নতমানের পাট বেশি কিনেছে। এ জন্য নতুন করে ২০০ কোটি টাকা দেনা হয়েছে বিজেএমসির। এখন সেই পাট বিক্রিও করতে পারছে না সংস্থাটি। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি আশ্বাস ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে তিন বছর ধরে চাষিরা পাটের আবাদ অব্যাহতভাবে বাড়িয়েছে। দুই বছরে বেসরকারি খাতে প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে ১৮টি নতুন পাটকল স্থাপিত হয়েছে। বাড়তি উৎপাদিত পাটপণ্য বাজারজাত করতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে পাটের নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু দুই বছরে বাংলাদেশ পাটের নতুন বাজার পায়নি, পুরনো ক্রেতাদের কাছেই পাট বিক্রি করেছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে মন্দা শুরু হওয়ায় বাংলাদেশ বিপাকে পড়েছে।
গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল। এ প্রতিশ্রুতি পূরণে যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার তাতে ঘাটতি থাকায় গত তিন বছরে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সাফল্য আসেনি। সরকারি আশ্বাস ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত তিন বছরে পাট উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলেও নতুন কোনো বাজার সৃষ্টি হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ায় এ বছর বাড়তি উৎপাদন কৃষকের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে আইন হওয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। পাটকে বাঁচানোর জন্য সরকারের উচিত আইন কার্যকর করা। পাশাপাশি বিদেশে বিকল্প বাজার খোঁজাও জরুরি। এ অবস্থায় কৃষকদের রক্ষায় সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে_এমনটাই কাম্য। এটি সরকারের নৈতিক দায়িত্ব বলেও বিবেচিত হওয়া উচিত। কৃষক বাঁচাতে, পাট বাঁচাতে এবং পাটের সুদিনের পূর্ণ সুযোগ যেন আমরা আমাদের ঘরে তুলতে পারি সে জন্য সরকারকে পাট শিল্প নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেশের সব বন্ধ সরকারি পাটকল অবিলম্বে খুলে দিতে হবে। একই সঙ্গে সেগুলোর আধুনিকায়ন ও সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের পাটজাত পণ্যের বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। একসময় কৃষিই ছিল এই জনপদের জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে না। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের উন্নয়নে এবং কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিছুদিন এ নিয়ে বেশ তোড়জোড়ও পরিলক্ষিত হয়। তারপর সব কিছু চলে সনাতন পদ্ধতিতে। উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে ফসলের। অথচ কৃষিপণ্যের বিপণন নিয়ে তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে শুধু বঞ্চিতই হয় না, অনেক সময় তারা পণ্য বিক্রির মাধ্যমে উৎপাদন খরচও তুলতে পারে না। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি পাটের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাষ্টদূতদের কাজ করতে হবে। সভা-সেমিনার করে পাটের পণ্য ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহী করতে হবে।
সরকার যদি কৃষকদের পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে উৎপাদন থেকে কৃষকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই আগে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করেই সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল করা। অসাধু ব্যবসায়ী, আড়ত কিংবা মজুদদার এবং বাজার সিন্ডিকেটের কবল থেকে কৃষকদের রক্ষা করা। কারণ কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ ও চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.