চরাচর-একজন মুক্তিযোদ্ধা গোপাল দাশ

গণিত মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতাকে পরাজিত করে অবশেষে অর্জিত হয় আমাদের এই মহান স্বাধীনতা। আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের অধিবাসী। কিন্তু পেছনের দিকে ফিরে তাকালে নারী-পুরুষ, শিশু-আবালবৃদ্ধবনিতার ওপরও অকথ্য নির্যাতনের বিভিন্ন কাহিনী আমরা খুঁজে পাব আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে। আমি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাখালকান্দি পশ্চিমপাড়া গ্রামের প্রাণ গোপাল বাবু দাশ নামে


সমধিক পরিচিত এক লোকের কথা বলব, যিনি ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তাঁর চোখের সামনে ঘটে গিয়েছিল মাখালকান্দি গ্রামের সেই ধ্বংসলীলা। ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে কয়েকটি নৌকা বানিয়াচং থেকে মাখালকান্দি গ্রামে আসছিল। আগের দিনটি ছিল মনসা পূজা। স্বাভাবিকভাবে মনসা পূজা অনেক জাঁকজমকভাবে উদ্যাপন করা, ঘরে ঘরে বলি দেওয়া ও আনন্দ-ফুর্তি করার আয়োজনটা ছিল এ গ্রামে প্রতিবছরের মতোই। সেদিন ভোরে পূজার কাজ চলছিল। কিছুক্ষণ পর ধেয়ে আসা নৌকাগুলোতে আরোহণ করা লোকগুলোর উদ্দেশ্য বোঝা গেল। আগের রাতে অঝোর বৃষ্টি হওয়ায় সকাল হলে পূজা না হওয়া দেবতা মূর্তির যাত্রা করেই দালানের ওপর উঠেছিলেন প্রাণ গোপাল দাশ। তখন তিনি দেখলেন নৌকাগুলো গ্রামের কাছে এসে চার-পাঁচ মিনিট এক জায়গায় স্থির থাকল, তারপর আরোহিত লোকগুলো কি যেন শলাপরামর্শ করে রমেশ সরকারের বাড়ির ঘাটে ভিড়ল। পরক্ষণেই তিনটি গুলির আওয়াজ শোনা গেল। সবার মতো গোপাল বুঝতে পারলেন গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিরা এসেছে। গোপাল দৌড়ে তাঁর মা-বাবার কাছে গেলেন। গোপাল, গোপালের বাবা ও গোপালের বোন নিভা_এবার তাঁদের পালা। তাঁদের টেনেহিঁচড়ে নেওয়ার সময় তাঁরা দেখতে পেলেন উঠানে শুধু রক্তাক্ত লাশের স্তূপ। গোপাল আবিষ্কার করলেন তাঁর জন্মদাত্রীর নিথর রক্তে রঙিন দেহটি লাশের স্তূপে পড়ে আছে। গোপাল আরো দেখলেন পাঞ্জাবিরা তাঁর চেনা মানুষগুলোকে উঠানের পশ্চিম দিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করছে, গুলি খেয়েও যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করছে। চারদিকে মৃত্যুর করুণ আর্তনাদ। গোপালের চোখের সামনে জয়তারা বিবি যে কিনা অল্প কিছুক্ষণ আগে এক সন্তান প্রসব করেছিলেন, তাঁকে ধরে নিয়ে গেল পাকিস্তানি হানাদাররা। সদ্য প্রসব হওয়া শিশুটি জয়তারার কোলেই ছিল। পাঞ্জাবিদের নিষ্ঠুর পাষাণ হাত কোল থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে মাটিতে। গোপালের সামনেই জয়তারার অসুস্থ দেহটি হানাদারদের লালসার শিকার হয়। তারপর আবারও গোপালের হাঁটার পালা। পশ্চিম গলিতে গিয়ে দেখল ছন-বাঁশের বাড়িগুলোতে লাগানো আগুনের নৃত্য। তারপর গোপালকে নিয়ে নৌকার দিকে যেতে লাগল। গোপাল স্পষ্ট অনুভব করলেন তাঁর পালা এসেছে। শুকিয়ে যাওয়া চোখ দুটো কষ্টে এবার ভিজে উঠল। ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্বরতা গোপালের চোখে ভাসছিল। এক পাঞ্জাবির কর্কশ ধমকে গোপালের চেতন ফিরল। শুনলেন পাঞ্জাবিটা বলছে, 'শুয়োরের বাচ্চা নৌকায় ওঠ'। নৌকায় উঠতে গিয়ে গোপালের মনে হচ্ছিল তাঁর লাশটা বুঝি আর কেউ দেখবে না, পানির স্রোতে ভেসে যাবে। এক পাঞ্জাবি তার হাতের রাইফেলটি গোপালের দিকে তাক করল। ওই মুহূর্তে পাশে বসা এক রাজাকার বলে উঠল, 'স্যার, ওটাকে মারবেন না, আমাকে দিয়ে দেন। বেটাকে আমি মুসলমান বানাব।' পাঞ্জাবি দলের সুবেদারই ছিল মেজর। গোপাল সেই মেজরকে দেখতে পেলেন না। পরে জানতে পেরেছেন সেই মেজর শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পে থাকত। গোপালকে অনেক দিন থাকতে হয়েছিল দালালদের ক্যাম্পে। সেখান থেকে গোপাল তাদের কুকর্মগুলো দেখত ও শুনত। বন্দিকালীন গোপাল নিজের মৃত্যু কামনা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু গোপালকে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে_তা থেকে গোপাল স্বাধীন হননি, সেই অভিশপ্ত স্মৃতি গোপাল আজও বহন করে চলছেন।
কেয়া চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.