দুই হারের বোঝা নিয়ে আজ আবার মাঠে বাংলাদেশ by নোমান মোহাম্মদ

নুশীলনটা ছিল ঐচ্ছিক। কিন্তু সাকিব-রাজ্জাক-শফিউল ছাড়া পুরো বাংলাদেশ দলই কাল তেড়েফুঁড়ে চলে এল স্টেডিয়ামে। আসবে না! আগের দুই ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর অনুশীলনে বাড়তি মনোযোগ তো দিতেই হচ্ছে। সিরিজের বাকি অংশে অন্তত 'মানরক্ষার-ক্রিকেট' খেলতে হবে যে!বন্ধনীর ওই শব্দযুগল নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। পারে না, থাকবেই। মুশফিকুর রহিম যেমন দিন কয়েক আগের সংবাদ সম্মেলনে জোর গলায় বলে
গিয়েছিলেন, সম্মানজনক পরাজয়ের অধ্যায় নাকি পেরিয়ে এসেছে দল, এখন প্রতি ম্যাচেই তারা নামেন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে। তা স্বপ্নের হাওয়াই জাহাজে তো আর কেউ শিকল পরিয়ে দিতে পারবে না। সেখানে ম্যাচ জয়, সিরিজ জয়, এমনকি হোয়াইটওয়াশের স্বপ্নও দেখতে পারে স্বাগতিক দল। তবে বাস্তবতা যে কতটা কঠিন, টোয়েন্টি টোয়েন্টি ও প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ার কথা। সফরকারীদের বোলিং তোপের মুখে কোনো ম্যাচে এক শ রানও করতে পারেনি যে! আজ দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের কথা উচ্চারণের সাহসও তাই বোধকরি অবশিষ্ট নেই দলের। অতএব, মানরক্ষার ক্রিকেট যদি তলানিতে ঠেকা আত্মবিশ্বাসে জ্বালানির কাজ করে, মন্দ কী!
অসম লড়াই! এর চেয়ে ভালোভাবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান চলতি সিরিজকে বর্ণনা করা যায় না। অতীতে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হলে সব সময়ই আমরা আশায় বুক বাঁধতাম। কেমন কেমন করে জানি, মাঝের দুঃস্বপ্নের প্রহরগুলো পেরিয়ে '৯৯-এর সুখস্মৃতিতে উড়াল দিত হৃদয়। সেই নর্দাম্পটন-মহাকাব্যের পুনরাবৃত্তির প্রত্যাশায় বুঁদ হয়ে থাকতাম সবাই। এরপর ম্যাচের পর ম্যাচ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় দগ্ধ হওয়া। '৯৯ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ কোনো না কোনো ফরম্যাটের ক্রিকেটে সব টেস্ট দলকেই হারিয়েছে। হারাতে পারেনি কেবল পাকিস্তানকে। এবারও প্রথম দুই ম্যাচে দুই দলের এমন আকাশ-পাতাল পার্থক্যের প্রতিফলন যে আশাবাদী হওয়ার উপায়ও নেই। স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে সিরিজই এটি হয়ে যায় কি না, এই আশঙ্কা বরং আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে স্টুয়ার্ট ল'র শিষ্যদের।
আগে তাও একটা ভরসা ছিল, পাকিস্তানের অনিশ্চিত ক্রিকেট-চরিত্রের। কোন দিন যে কেমন খেলবে, এ সম্পর্কে খাটত না কোনো পূর্বানুমান। দল হিসেবে তাদের ফর্ম ছিল ব্যাটসম্যান হিসেবে মোহাম্মদ আশরাফুলের ফর্মের মতো। কখনো বিশ্ব তাদের পদানত, এরপরই হয়তো বহু দিন নিজেদের হারিয়ে খোঁজা। আশরাফুল রয়ে গেছেন তাঁর মতোই, তবে বদলে গেছে পাকিস্তান। এখন তারা বিস্ময়ক রকম ধারাবাহিক। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার পাশাপাশি এ বছর খেলা পাঁচটি ওয়ানডে সিরিজের সব কটিতে জিতেছে। ষষ্ঠটি জেতা যে কেবল সময়ের ব্যাপার, সেটি বোধকরি না বললেও চলছে।
তাহলে কি হাত-পা গুটিয়ে কেবল পরাজয়ের প্রহর গুনবে বাংলাদেশ? তা না। সে জন্যই তো দলবলসহ অনুশীলনের ওই বাড়তি তাগিদ। পাকিস্তান কাল আর হোটেলের আরামদায়ক আলস্য ছেড়ে মাঠে আসার কষ্ট স্বীকার করেনি। বাংলাদেশ প্র্যাকটিস করেছে পুরোমাত্রার। সেখানে কোচ তাদের কানে কোন মন্ত্র গুঁজে দিয়েছেন, পাকিস্তানকে সামলানোর পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন এল কি না_সেসব জানার উপায় নেই। চাপে নুয়ে পড়া বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে সংবাদমাধ্যমের সামনেই আসতে চাইলেন না। শাহরিয়ার নাফীস কেবল বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, 'এখন কোনো কথা বলব না। আসলে কথা বলতে লজ্জা লাগে। ভালো খেলার পর বলব।'
কোচের নির্দেশনা জানা গেলেও অনুমানের একটা উপায় আছে। সেই অনুমানের ভিত্তি নির্বাচকদের পরামর্শ। মিরপুর স্টেডিয়ামের করিডোরে দাঁড়িয়ে দুই নির্বাচক আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদীন জানালেন দলের প্রতি তাঁদের পরামর্শ। 'আমাদের টার্গেট করতে হবে, যেন পুরো ৫০ ওভার ব্যাটিং করতে পারি। আর খেলতে হবে সোজা ব্যাটে। পাকিস্তানি স্পিনারদের বিপক্ষে কাট করতে গিয়ে দেখলেন না, কী বিপদ হয়ে যাচ্ছে! ওদের স্পিনাররা যেহেতু অনেক জোরে বোলিং করে, সে কারণে হেরফের হয়ে যাচ্ছে টাইমিংয়ের। উঠে যাচ্ছে তাই ক্যাচ'_বলছিলেন মিনহাজুল। তাঁর ৫০ ওভার খেলা এবং সোজা খেলার পরামর্শে মনে পড়তে বাধ্য, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই আদ্দিকালকে। যখন ৫০ ওভার ব্যাটিং করতে পারাটাই ছিল সম্মানজনক। আর বাংলাদেশের সাবেক পাকিস্তানি কোচ মহসিন কামালের 'সিধা সে খেলো' তত্ত্ব তো এখনো হাসির খোরাক জোগায় ক্রিকেট আড্ডায়।
ওইসব সময় পেরিয়ে কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট? বিশ্বকাপ চলাকালীন সময় তখনকার অধিনায়ক সাকিব দাবি করেছিলেন, অনেকটা এগোনোর। কিন্তু এক বছরে তিনবার ওয়ানডেতে ১০০ রানের নিচে গুটিয়ে যাওয়া কিন্তু সে সাক্ষ্য দেয় না। পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে ৮৫/৯ এবং ৯১/১০ স্কোর তো আরো নয়। সে কারণেই প্রথম ওয়ানডের পর সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুরের স্বীকারোক্তি, 'আসলে যতটা এগোনোর কথা ছিল, ততটা এগোতে পারিনি আমরা।'
অতীতে ফিরে যাওয়ার চোখ রাঙানিতে জবুথবু হয়ে থাকা বাংলাদেশের আজকের ম্যাচের প্রতিপক্ষ শুধু পাকিস্তান না, উইকেটও। ২২ গজের ওই রহস্যময় চতুর্ভুজের সব রহস্যময়তা নিয়ে হাজির হয়েছে এই সিরিজে। আগের দুই ম্যাচে নিজেদের উইকেটে বাংলাদেশকে খাবি খেতে দেখে পাকিস্তানিদের উপহাসের পাত্র হতে হয়েছে বাংলাদেশের। অধিনায়কও বলে গেছেন, চাহিদামাফিক উইকেট তিনি পাচ্ছেন না, হোম অ্যাডভান্টেজের ছিটেফোঁটাও তাই নিতে পারছে না তাঁর দল। পাঁচ নম্বর উইকেট থেকে আজ কি সেটি পাবে বাংলাদেশ? কাল প্রভাত থেকে গোধূলি পর্যন্ত মাঠকর্মীদের নিয়ে কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার পরিচর্যার ফল দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় কী!
নাজুক ফর্ম, ভঙ্গুর আত্মবিশ্বাস আর উইকেটের বিশ্বাসঘাতকতার বাধা টপকে আজ কোন বাংলাদেশকে দেখা যাবে? সিরিজ-পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখনো সিরিজ জয়ের লক্ষ্য আছে কি না, কোচ-অধিনায়কের কাছ থেকে সেটি জানার উপায় নেই। প্রধান নির্বাচক আকরাম খান অবশ্য আপাতত খারিজ করে দিয়েছেন সে সম্ভাবনা, 'কিসের সিরিজ জয়? ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। দুটো ম্যাচ ১০০-এর নিচে গুটিয়ে যাওয়ার পর অমন কিছু ভাবার অবস্থাতেই নেই আমরা। দলের আত্মবিশ্বাস খুব কম, এখন ভালো ক্রিকেট খেলতে পারলেই হয়।' প্রতিপক্ষ পাকিস্তান বলেই ভয়টা আরো বেশি করে। প্রতিভাবান দলটি যে এখন আবার ধারাবাহিকও। তবে যে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত দলটি পাকিস্তান বলে কিছু আশাও থাকে। আর অতীতও তো সাক্ষ্য দিচ্ছে, সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় চলে যাওয়ার পরই আবার ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
তাই হয়তো আজই...আরেকবার...!

No comments

Powered by Blogger.