সমকালীন প্রসঙ্গ-খেলার মাঠে হারিয়ে যাবে রাজনীতি? by আবু সাঈদ খান

নেতৃত্বের ভুলের অনেক খেসারত এ জাতি দিয়েছে। আর ভুল নয়, ভুলের খেসারত নয়_ ভুল শোধরাতে হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এক টেবিলে বসতে হবে। কে ভালো, কে মন্দ সে রায় জনগণ দেবে। কেউ অপরাধী হলে আদালত সে বিচার করবেন। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাই দেশ ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে এক সঙ্গে বসুন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া কী হবে আর কোন প্রক্রিয়ায় সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে তা ঠিক করুন


ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া মাসব্যাপী রোডমার্চ ও জনসভার কর্মসূচি পালনের প্রাক্কালে সরকার পতনের ফাইনাল খেলার কথা বলেছেন। সরকার দলের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, তারা ফাইনাল খেলার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিরোধী দল কি এখনই সরকার উৎখাতের আন্দোলনের ডাক দিয়েছে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের কথায় তা মনে হয় না। তিনি বলেছেন, ফাইনাল খেলা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। ক্ষমতাসীন মহাজোটের নেতারাও নির্বাচনকেই ফাইনাল খেলার ক্ষেত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সংশয়ের অবকাশ নেই যে, দেশের রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনের দুই বছর বাকি থাকলেও সরকার ও বিরোধী দল প্রস্তুত হচ্ছে সাধারণ নির্বাচনের জন্য।
তবে নির্ধারিত সময়ের দু'বছর আগেই নির্বাচনের ডামাডোল বেজে ওঠা খুব ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, জনস্বার্থ ইস্যুগুলোর বাস্তবায়ন, সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণ, বিরোধী দলের ভূমিকা_ কোনো কিছুরই হিসাব-নিকাশ হচ্ছে না। সব ইস্যু ঝুলিয়ে রেখে নির্বাচনের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া কতটুকু যৌক্তিক। এভাবে এত আগে নির্বাচনে মেতে উঠলে সরকার, বিরোধী দল_ কোনো দলের কার্যক্রমের যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে না। তারপরও উপায় কী? জনতার সিংহভাগ দুই দলে বা দুই জোটে বিভক্ত। দুই নেত্রী যেদিকে যান তারা সেদিকেই দৌড়ায়। তাছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানটি বাতিল হওয়ায় সব ছাপিয়ে রাজনীতি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। এটিকে আর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
২৭ সেপ্টেম্বর বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। ১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন, আর সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে আসতেই হবে। এর মানে সরকার আর বিরোধী দল কার্যত মুখোমুখি। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করবেই, আর বিরোধী দল ঠেকাবেই_ এই যদি বড় দুই দলের মনোভাব হয় তাহলে সংঘাত অনিবার্য। এ সংঘাতময় পরিবেশে সরকার বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন করতে সক্ষম হলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি যে একতরফা নির্বাচন করেছিল, এবারও সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই যে নির্বাচন সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হবে তা জোর দিয়ে বলা যায় না। এ যাবৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব কয়টি নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধী দল কারচুপির অভিযোগ করেছে। এ ধরনের অভিযোগ করাটাই হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এটি স্বীকার করতেই হয়, ১৯৯১ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো জনগণের কাছে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত হয়েছে। তবে মডেল হিসেবে এর বেশকিছু ত্রুটি আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত যে, এ ব্যবস্থা বিচার বিভাগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়ে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আনার যে প্রয়াস তা সাম্প্রতিককালে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এ ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা বিচার বিভাগের কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করছে বলে অভিযোগ আছে। আবার আজকের বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আস্থা রাখা যায় না। ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ করা হবে এবং নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানেই। এটি বিধিসম্মত। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে শক্তিশালী, স্বাধীন ও তৎপর নির্বাচন কমিশন রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অধীনেই সেখানে সব পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের বিধান অনুযায়ী, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, পুলিশ, প্রশাসন_ সবকিছুর ওপর সরকারের হাত থাকে। নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর ক্ষমতা দেওয়ার পরও সরকারি প্রভাবের আশঙ্কা থেকে যায়। তারপরও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। এখন কীভাবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের ঐকমত্যও জরুরি। ইতিমধ্যে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের কথা রাজনৈতিক ও বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে। সেটি যৌক্তিক প্রস্তাব। দলীয় সরকারের অধীনেই হোক আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হোক_ নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য স্বাধীন ও সক্ষম কমিশন গঠন এখন সামনের চ্যালেঞ্জ। তবে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলেই যে সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ রাতারাতি দূর হয়ে যাবে এমনটা ভাবা যায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো স্থায়ী বিধান নয়, এটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিধান কত দিনের জন্য প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি অভিমত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আজকের বাস্তবতায় দুই মেয়াদের জন্য এটি বহাল রাখা যেতে পারে। আসলে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলকে একমত হয়ে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব অভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতে পারলে কী হবে? পর্দার আড়ালের শক্তির হস্তক্ষেপের সুযোগ অবারিত হবে। আমরা ভুলে যেতে পারি না, ১/১১-এর পশ্চাৎপটে ছিল রাজনৈতিক সংঘাত। সেই সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য তৎকালীন বিএনপি সরকারই ছিল প্রধানত দায়ী। তখন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার জন্য গোঁয়ার্তুমি এবং তা করতে না পেরে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তই রাজনীতিকে সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগসহ সেদিনের আন্দোলনকারীদের পূর্বাপর অনেক ভুল পদক্ষেপও ছিল। সরকার যৌক্তিক অবস্থানে থাকলে হয়তো পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটত না। আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায় সরকারেরই। সেই দায় যেমন সরকার এড়াতে পারে না, তেমনি আজও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের কারণে কোনো অঘটন ঘটলে সে দায় বর্তমান সরকার এড়াতে পারবে না।
একই ঘটনা দু'বার ঘটে না। অনুরূপ ঘটনা ঘটলেও তা ঘটে ভিন্ন আঙ্গিকে। সেই আঙ্গিক কী, আমরা জানি না। তবে তা জাতীয় অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে_ সেটি নিদ্বর্িধায় বলে দেওয়া যায়। এখন ভাবতে চাই, সরকার যদি একতরফাভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করে তাহলে কী হবে? এমন নির্বাচন করতে পারবে কি পারবে না সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের নির্বাচন হলে কী হবে? সেই নির্বাচনে কোন কোন দল অংশ নেবে? কথাবার্তায় গোপন নেই যে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমন নির্বাচনী মওকা লুফে নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেছেন, তারা মহাজোটের সঙ্গে নয়, আগামী নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেবেন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ না নিলে তখন বিরোধী দলের অবস্থানে আসীন হবে জাতীয় পার্টি। যদিও তখন তিনি হবেন গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা। অশীতিপর বৃদ্ধ জেনারেলের জন্য এটি বড় প্রাপ্তি!
এমন একটি মডেল ১৯৮৮ সালে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের নির্বাচন বর্জনের মুখে আ স ম রবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন। এর স্থায়িত্ব হয়েছিল দুই বছর। এবার যদি বর্তমান সরকারের হাত দিয়ে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে এরশাদ হবেন সেই মডেলের তাত্তি্বক। আর তত্ত্বদাতা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছু খসিয়ে নিতে
পারবেন তিনি।
এখন দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচনের মাধ্যমে ফাইনাল খেলতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি প্রস্তুত। তবে জনগণ বিএনপিকে বাদ দিয়ে এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনী খেলা দেখতে চায় না। জনগণের এ অভিপ্রায়কে অগ্রাহ্য করে যদি এরশাদের সঙ্গে ফাইনাল খেলা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত, এরশাদের টার্গেটও অর্জিত হবে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ দিয়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তা হারিয়ে যেতে পারে ভিন্ন কোনো এক খেলায়!
এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমাদের রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কেবলই অনৈক্যের দৃষ্টান্ত আছে তা নয়। স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন আমলে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ১৯৯৬ সালে সমঝোতার ভিত্তিতেই সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল, ১/১১-এর মধ্য দিয়ে আসা সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব একাট্টা হয়েছিল। গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে এসব ঘটে থাকলে আজ কেন তা অসম্ভব? এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বকে দলীয় স্বার্থ ছাড়তে হবে, দল ও গোষ্ঠীর ঊধর্ে্ব স্থান দিতে হবে জাতীয় স্বার্থ। নেতৃত্বের ভুলের অনেক খেসারত এ জাতি দিয়েছে। আর ভুল নয়, ভুলের খেসারত নয়_ ভুল শোধরাতে হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে এক টেবিলে বসতে হবে। কে ভালো, কে মন্দ সে রায় জনগণ দেবে। কেউ অপরাধী হলে আদালত সে বিচার করবেন। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাই দেশ ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে এক সঙ্গে বসুন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া কী হবে আর কোন প্রক্রিয়ায়
সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে তা
ঠিক করুন।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.