পুপু, পুপুর বাবা ও পুপুর মা

ন ঠাকুরের গল্প
পুপুকে দেখলে বোঝাই যাবে না যে, পুপুর বাবা কেমন মানুষ?
পুপু এতো চঞ্চল। আর পুপুর বাবা খুব নরম এবং লাজুক মানুষ।
পুপুর একটু ঘুম বেশি হয়। কিন্তু পুপুর বাবা সারারাত জেগে থাকে।


পুপু কাউকে দেখলেই একথা-সেকথা নানান কথা বলে।
পুপুর বাবা কথা প্রায় বলতেই চায় না।
পুপু কার্টুন-সিনেমা, এনিমেশন দেখতে চায় না।
পুপুর বাবা সময় পেলে এগুলোই বেশি দ্যাখে।
পুপু সম্ভবত নদীই দ্যাখেনি। পুপুর বাবা নদীতীরের মানুষ।
পুপু জোনাকি পছন্দ করে, প্রজাপতি পছন্দ করে।
পুপুর বাবা ফড়িং পছন্দ করে, পাখি পছন্দ করে।
কিন্তু তারা দু'জনেই পছন্দ করে মেঘ। দু'জনেই পছন্দ করে শীতকাল।
শীতকাল পছন্দ করার কারণ কী?
পুপুর উত্তর, 'বাবার সঙ্গে হাঁটতে বেরোলে মজা লাগে।'
কেন মজা লাগে?
পুপু বলে, 'কারণ, বাবা আর আমি হাঁটতে বেরোই খুব ভোরবেলা, আর যখন সন্ধ্যা নেমে আসে।'
তখন কেন মজা লাগে হাঁটতে?
পুপু বলে, 'কুশা থাকে। কুশায় হাঁটতে ভারি মজা।'
কুশা কী?
পুপু বলে, 'কুশা চিনলে না? কুশা হচ্ছে কুশা। শাদা শাদা।'
কী রকম শাদা?
পুপু বলে, 'শাদা বোঝো না? তাইলে কুশা বোঝাবো কেমন করে?'
আসলে পুপু এখনও কুয়াশা শব্দটি বলতে পারে না। শীতের কুয়াশা তাই 'কুশা' হয়ে যায় পুপুর কাছে।
আবার বলি, 'পুপু, তোমার বাবার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়?'
পুপু বলে, 'হয়।'
কী নিয়ে?
'অনেক কিছু নিয়ে।'
যেমন?
'যেমন আবার কী?' পুপু প্রশ্ন করে।
তো কী বলবো?
'বলো, কেমন?' পুপু উত্তর দেয়।
পুপুকে বলি, কেমন? কেমন ঝগড়া? কী নিয়ে ঝগড়া?
পুপু বলে, 'ডাকাডাকি নিয়ে ঝগড়া।'
ডাকাডাকি নিয়ে ঝগড়া? মানে?
'মানে বুঝলে না?'
না।
'মানে হচ্ছে, বাবা যখন ঘুমোয়, তখন ভোর হয়। তোমাকে তো আগেই বলেছি, ভোরের কুশায় আমার হাঁটতে ভালো লাগে। তাই বাবাকে ডাকি। বাবা তো উঠতেই চায় না। আমি আবার ডাকি। তখন বাবা ওঠে। তারপর আমরা হাঁটতে বেরোই।'
তো ঝগড়া হয় কখন?
'যখন রাস্তায় হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতে বাবাই হঠাৎ বলে, আমাকে তুই ডাকলি কেন?'
তুমি তখন কী বলো?
'আমি বলি যে, কুশায় হাঁটবো বলে ডেকেছি। তখন বাবা কী বলে জানো?
বাবা বলে, খালি কুশা আর কুশা। কুশা কি সন্ধ্যায় আসে না? বল, আমার ঘুম ভাঙালি কেন? আর কুশা কি ধরা যায়, ছোঁয়া যায়?'
তখন তুমি কী বলো?
'আগে শোনোই না, আমি বাবাকে বলি, সন্ধ্যার কুশা সন্ধ্যার মতো, ভোরের কুশা ভোরের মতো। সন্ধ্যার কুশার পর কখন যেন রাত হয়ে যায়; কিন্তু ভোরের কুশার মদ্দি হাঁটতে হাঁটতে রোদ উঠে পড়ে। বলো, সত্যি কি-না? বাবা তখন আর কথা বলে না। তখন বাবারও খুব মন খারাপ থাকে। তারপর আরও অনেক কথা। আমি আবার বাবাকে বলি, তোমাকে না ডাকলে কি এই কুশার মদ্দি দিয়ে হাঁটতে পারতাম? এতো ভোরে আমি রাস্তায় আসতে পারতাম? বাবা কিন্তু আর কথা বলে না। বাবাও কুশা ভালোবাসে, আমার মতো।'
পুপুর কথা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই যখনই সময় পাই, পুপুদের বাসায় যাই।
পুপুদের বাসায় আর কে থাকে?
একদল চড়ূই থাকে। একটা বিড়াল থাকে। সেই বিড়ালের নাম ঘড়ি। বিড়ালের নাম ঘড়ি? হ্যাঁ, তাই। বিড়াল যখন মিউমিউ করে ডাকে, পুপু বলে, 'আমার ঘড়িটা ডাকছে'। বিড়াল যখন ঘুমোয়, পুপু বলে, 'আমার ঘড়িটা ঘুমোচ্ছে।'
পুপুদের বাসায় আরও থাকে একটা ফড়িং, সেটা পুপুর বাবা খড় দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। আর যে প্রজাপতিটি থাকে, সেটা ওর বাবা কী দিয়ে যে বানিয়েছে, পুপু তা বুঝতেই পারে না। আরও আছে একটা দোয়েল পাখি। সেটা বানানো শোলা দিয়ে।
পুপু আর পুপুর বাবার মধ্যে এক জায়গায় খুব মিল। দু'জনেই তারা ছবি আঁকে। পুপুর বাবা খুব নামকরা শিল্পী। পুপুকে ওর বন্ধুরা ছাড়া এখনও তেমন কেউ চেনে না। পুপু ইশকুলে যায়; কিন্তু ইশকুল তার ভালো লাগে না। ইশকুলের বন্ধুদের ভালো লাগে। ইশকুলে গিয়ে সে শুধু তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে। ক্লাসে যখন ম্যাডাম আসে, বেঞ্চে বসে পুপুর তখন ঘুম পায়। আস্তে করে মাথাটা বেঞ্চের ওপর রেখে সে ঘুমায়। দু'একদিন ম্যাডামও টের পেয়েছে। ক্লাসে সবার মধ্যে ম্যাডাম পুপুকে লজ্জা দিয়েছে। কিন্তু ক্লাসে বসে পুপুর ঘুম পাওয়া বন্ধ হয়নি।
আজ দুপুরে তেমন কাজ নেই। পুপুদের বাসায় গেলাম। দরজায় কড়া নাড়তেই পুপু দরোজা খুলে দিলো। ভেতরে ঢুকে পুপুকে বলি, বাবা বাসায় নেই?
পুপু বলে, 'না'।
কোথায়?
'বাইরে'।
বাইরে কোথায়, তুমি জানো না?
'না'।
পুপু, তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো, উত্তর দেবে?
'দেবো। কী প্রশ্ন?'
তোমার মার কথা মনে পড়ে?
পুপুর মুখ হঠাৎ কালো হয়ে যায়। পুপু মাথা নিচু করে ফ্যালে। একটু আনমনা হয়ে যায়। তারপর উত্তর দেয়, 'পড়ে'।
আবার প্রশ্ন করি, 'মার সঙ্গে তোমার দেখা হয়?'
পুপু মাথা ঝাঁকায়।
কখন দেখা হয়?
'শীতকালে'।
শীতকালে তোমার মার সঙ্গে দেখা হয়? অন্য সময় হয় না?
'না'।
তোমার মা কোথায় থাকে, মানে তোমার মার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়?
পুপু সহসা উত্তর দেয় না। ঘাড় গুঁজে বসে থাকে।
আমারও আর প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে না। আমি পুপুকে অন্য কথা বলি, পুপু শীতকালে কোন কোন ফুল ফোটে জানো?
'জানি'।
শীতকালে শিশির পড়ে কেন জানো?
পুপু বলে, 'জানি'।
আবার বলি, শীতকালে শীতের পাখি আসে অন্য দেশ থেকে, জানো?
পুপু উত্তর দেয়, 'জানি'।
সেই পাখি তুমি দেখেছো?
'দেখেছি'।
আবার আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু দু'জন চেনা মানুষ যদি এক জায়গায় থাকা যায়, তখন কি কথা না বলে পারা যায়? যায় না। আমি পুপুকে বলি, পুপু, তোমাকে যে আমি এতো প্রশ্ন করি, তুমি তো একটাও প্রশ্ন করো না। কেন করো না?
পুপু জবাব দেয় না।
বলি_ পুপু, তুমি একটা প্রশ্ন করো আমাকে।
পুপু প্রশ্ন করে না। অথচ সে একা একা এতো চঞ্চল, এতো ছোটাছুটি করে।
আবার বলি, মার কথা জিজ্ঞেস করেছি বলে দুঃখ পেয়েছো?
পুপু ঘাড় ঝাঁকিয়ে 'না' বলে। যদিও আমি জানি, মার কথা বললেই সে থমকে যায়, কথা বলতে চায় না।
পুপুকে বলি, আমি তোমার মার কথা আর জিজ্ঞেস করবো না।
পুপু আমার দিকে তাকায়। আমিও থমকে যাই। পুপুর চোখ চিকচিক করছে কি? পুপু কি কাঁদছে?
আমি বলি, পুপু, তুমি কাঁদছো?
পুপু কান্নাজড়ানো গলায় শব্দ করে বলে, 'না'।
আবার বলি, তোমার মার সঙ্গে যে তোমার শীতকালে দেখা হয়, কোথায় দেখা হয়_ বললে না তো?
'কুশায় দেখা হয়'। পুপুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
কুয়াশায় তোমার মার সঙ্গে দেখা হয়? এই জন্য ভোরবেলায় আর সন্ধ্যাবেলায় হাঁটতে বেরোও? বাবার সঙ্গেও দেখা হয়?
পুপু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে 'হ্যাঁ'।
'কুশায় আমার মা হারিয়ে গেছে।' আমি কোনো প্রশ্ন করিনি, কিন্তু পুপু নিজ থেকেই বলে। আরও বলে, 'কুশার মধ্যে যখন আমি আর বাবা হাঁটি, মনে হয় মাও আছে আমাদের সঙ্গে। মাও হাঁটছে।'
পুপু আরও কাঁদতে পারে দেখে আমি বলি_ আজ উঠি, তোমার বাবা এলে আমার কথা বোলো।
আমি পুপুদের বাসা থেকে বেরিয়ে আসি।

No comments

Powered by Blogger.