'সিনাকে'র স্নেহের ছায়া by বদরুদ্দোজা সুমন

পাঁচ বছর বয়সী অটিস্টিক শিশু 'আনা' মারাত্মক আক্রমণাত্মক ছিল। ক্ষেপে গেলে অন্যের চুল টেনে ধরে, কামড়ে দেয়। কারও কথা শুনত না। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের অটিজম সেন্টারে চিকিৎসাধীন এই শিশুটির রূঢ় আচরণের শিকার হয়েছেন প্রায় সব শিক্ষক। তাকে টেবিলে বসানোই যেত না। টানা তিন মাসের নিরবচ্ছিন্ন ও সমন্বিত সেবায় এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন ডাক দিলে সাড়া দেয়। খাওয়া, খেলাধুলাসহ নিজের দু'একটি কাজ নিজেই করার চেষ্টা করে।


মেজাজ ক্রমশ শান্ত হচ্ছে। তীব্র খাটুনির পর এটুকু উন্নতি দেখে সেন্টারের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের চোখের কোণে আনন্দাশ্রু গড়ায়। সৃষ্টির আনন্দ থেকেই এই অশ্রু।
আনার মতোই জাহিন, বৃষ্টি, সানাই, সুনেহরা_ সবাই অটিজমের শিকার। আচার-আচরণ ও যোগাযোগের সামর্থ্য বিচারে অন্য শিশুদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বয়স অনুপাতে কারোরই মানসিক
বিকাশ হয়নি। এই

শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন (সিনাক)।' প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ও মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতায় কেন্দ্রটি চলছে। এটি সরকারি সহায়তায় পরিচালিত দেশের একমাত্র অটিজম সেন্টার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেন্টারটি ক্রমশ অটিজম সেবার পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়ে উঠছে।
সিনাক সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ৬০ জন নিউরোলজিক্যাল সমস্যায় আক্রান্ত শিশু বহির্বিভাগে সেবা নেয়। তন্মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গড়ে সাতটি শিশু অটিস্টিক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সেন্টারের কর্মসূচি সমন্বয়ক ও পরিচালক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহীন আকতার সমকালকে বলেন, অবুঝ এই শিশুদের অস্বাভাবিকতা যে কাউকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চারশ' শিশু সেবার আওতায় এসেছে।
অটিস্টিক শিশুরা সামাজিক যোগাযোগ করতে পারে না, সমবয়সী অন্যদের সঙ্গে খেলে না, নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। অনেকে কথা বলতে পারে না। আলোর সংস্পর্শে আনলে পালানোর চেষ্টা করে। কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের লক্ষণ দেখা গেলে অটিজম সন্দেহ করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত শনিবার দুপুরে সিনাকের নিচতলায় ছয় মাসের শিশুকন্যা বৃষ্টিকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মা জাহানারা। স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর মাতুয়াইলে। সমকালকে তিনি বলেন, তিন মাস বয়স থেকেই দেখছি মেয়ে চোখে তাকায় না, ডাক দিলে সাড়া দেয় না। আপনমনে হাসে। কয়েক জন শিশু বিশেষজ্ঞ দেখালেও লাভ হয়নি। এই কেন্দ্রের সন্ধান পেয়েই চলে এসেছি। ডাক্তার বলেছেন, থেরাপি দিতে হবে।
অটিজম ডায়াগনস্টিক চেকলিস্ট (এডিসিএল), এমচার্ট ও এডোস_ প্রধানত এই তিনটি পরীক্ষার মাধ্যমে অটিজম শনাক্ত করা হয়। সমস্যার ব্যাপকতা বিচারে মৃদু, মাঝারি ও মারাত্মক_ তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে শিশুর মনস্তত্ত্ব বিকাশে কাজ করেন শিক্ষকরা।
সিনাকের বিশেষজ্ঞরা জানান, এখানে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচে অটিস্টিক শিশুদের সেবা চলে। বিশেষজ্ঞ শিশু নিউরোলজিস্ট, ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্ট ও অটিজম প্রশিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত টিম শিশুর মনস্তাত্তি্বক বিকাশের চেষ্টা চালায়। কেন্দ্রে তিন থেকে আট বছর বয়সী শিশুরা ডে-কেয়ার (দিবাযত্ন) পায়। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত নয়টি অটিস্টিক শিশু বর্তমানে সেখানে সেবা পাচ্ছে। খেলার ছলে ও হাতেকলমে নিজের কাজ নিজে করতে শেখানো হয়। অত্যাধুনিক সামগ্রী সমৃদ্ধ খেলাঘরে শিশুদের মস্তিষ্ক ও বুদ্ধি বিকাশের কাজ চলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত সমকালকে বলেন, ঈশ্বরপ্রদত্ত এই শিশুদের জন্য যা কিছু করা দরকার তা করতে পিছপা হব না। অটিস্টিক শিশুদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কন্যার মমত্ব এবং এই সেন্টারে তার পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের কাজের স্পৃহা বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরেজমিন কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেছে, অটিস্টিক শিশুদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় প্রায় সব সুবিধা সিনাকে সংযোজিত হয়েছে। কেন্দ্রটি পুরোপুরি শিশুবান্ধব। এটি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা শাখা, নিউরোলজি ফলোআপ ক্লিনিক, মৃগী ক্লিনিক, অটিজমের তীব্রতা পরিমাপক কক্ষ, মনস্তত্ত্ব পরিমাপক কক্ষ, ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি রুম ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত।
কেন্দ্রে প্রদত্ত সেবা সম্পর্কে কর্তব্যরতরা জানান, আউটডোরে সব ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা ও প্রতিবন্ধিতা-সংশ্লিষ্ট সব সেবা দেওয়া হয়। অটিজম শনাক্ত হলে ডে-কেয়ার স্কুল ও ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্টদের কাছে পাঠানো হয়। লেকচারার/প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে মস্তিষ্ক বিকাশের কাজ চলে।
অটিজম সেন্টার নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. প্রাণগোপাল দত্ত বলেন, চিকিৎসা বা সেবার পাশাপাশি দেশজুড়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং অটিজমের ব্যাপ্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে গবেষণাকাজ চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
ডে-কেয়ার কেন্দ্রে (স্কুল) এখনও অনেক শিশুকে ভর্তি করার সুবিধা চালু করা যায়নি। কর্মকর্তারা বলেছেন, পর্যায়ক্রমে সেবা সম্প্রসারণ করা হবে। অবশ্য ডে-কেয়ার সুবিধাপ্রাপ্ত নয়টি শিশু ছাড়া অন্যদের জন্যও ভর্তি ব্যতিরেকে উন্নত সেবা নিশ্চিত করেছে সিনাক। যারা ভর্তির সুযোগ পায়নি সেসব শিশুকে সিডিউল অনুযায়ী কেন্দ্রে নিয়ে আসেন বাবা-মায়েরা। প্রশিক্ষকরা প্রয়োজনীয় থেরাপি ও অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করে দিচ্ছেন। স্কুল সেবা সম্প্রসারণ বিষয়ে কেন্দ্রের পরিচালক ডা. শাহীন আকতার সমকালকে বলেন, স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তবে আমাদের ইচ্ছা আছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা জোরদারে এটি ভূমিকা রাখবে।
এই কেন্দ্রে অটিস্টিক শিশুর সেবা অনেক কম খরচে পাওয়া যায়। সিনাকের প্রশিক্ষকরা জানান, ডে-কেয়ার স্কুলে সেশন ফি বাবদ মাত্র দুই হাজার টাকা নেওয়া হয়। প্রতি মাসে বেতন এক হাজার টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর মাসিক বেতন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
অটিজম লেকচারার মনিরা আখতার সমকালকে বলেন, প্রতিটি শিশুর জন্যই পৃথক প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা (আইইপি) তৈরি করতে হয়। এটি অনেক সময়সাপেক্ষ। শিশু যখন সামাজিক যোগাযোগে অভ্যস্ত হয়, নির্দেশনা মেনে চলে, তখন পরিশ্রম সার্থক হয়।
সবার প্রত্যাশা_ 'সিনাক'-এর স্নেহের ছায়ায় অটিস্টিক শিশুরা স্বাভাবিক জীবনের আনন্দময় ভুবনে সবার বন্ধু হয়ে উঠবে।

No comments

Powered by Blogger.