ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে ইসরায়েলের এত বিপত্তি কেন? by গাজীউল হাসান খান

বার যেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনের মূল আলোচ্য বিষয়ই ছিল ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘে তার সদস্যপদ অর্জন নিয়ে বলতে গেলে গত এক বছর জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে চলছিল আলোচনা এবং দ্বিপক্ষীয়সহ বহুপক্ষীয় কূটনীতি। এবার জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনকে কেন্দ্র করে তাই বিষয়টি শীর্ষে উঠে এসেছিল। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সবার দৃষ্টি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিডেন্ট


বারাক ওবামার ভূমিকার ওপর। গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দাঁড়িয়েই প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা করেছিলেন, 'দুটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের চলমান সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। সব কিছু ঠিকমতো এগোলে আগামী বছরই আমরা ফিলিস্তিনকে বিশ্বসভার নতুন সদস্য হিসেবে পেতে পারি।' সে ঘোষণা ফিলিস্তিন ও বিশ্ববাসীর মধ্যে এক নতুন আলো ও আশার সঞ্চার করেছিল। কারণ তারও আগে, অর্থাৎ ২০০৯ সালের ৫ জুন মিসর বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে ভাষণদানকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে না এবং তিনি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে একটি 'দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান'-এর আশ্বাস ব্যক্ত করেন। ফিলিস্তিনের অবস্থাকে তিনি একটি 'অসহনীয় দখলদারি' বলে উল্লেখ করেন এবং ইসরায়েলের বসতি নির্মাণকে আন্তর্জাতিক আইনে 'সম্পূর্ণ অবৈধ' বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু তার দেড় বছরের ব্যবধানেই প্রেসিডেন্ট ওবামার ভূমিকা ও বক্তব্য সম্পূর্ণ বদলে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং ওয়াশিংটনভিত্তিক শক্তিশালী ইসরায়েলি লবির প্রচণ্ড চাপের মুখে ওবামা এক চরম ও বহুমুখী সংকটের সম্মুখীন হন। ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় ওবামার দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাবনা অত্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। সে অবস্থায় শক্তিশালী মার্কিন ইহুদি লবি ও ইসরায়েলের ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির মুখে প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্রমেই তাঁর ভূমিকা পরিবর্তন করতে শুরু করেন এবং পর্যায়ক্রমে অতি দ্রুততার সঙ্গে ওবামা তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও অতীতের ভূমিকা হারিয়ে ফেলেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জাতিসংঘে প্রদত্ত তাঁর এবারের ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সদস্যপদ লাভসংক্রান্ত বিভিন্ন উক্তির মধ্য দিয়ে। ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি নির্মাণকে যে ওবামা একদিন সম্পূর্ণ অবৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং বিনা দ্বিধায় স্বীকৃতি দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনের ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানাকে, তিনি এখন ইহুদিদের বেআইনিভাবে বসতি নির্মাণ বন্ধ করার ব্যাপারে একটি কথাও আর বলছেন না। তা ছাড়া ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমানা মেনে নিলেও পূর্ব জেরুজালেমের (আল-কুদস) মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে ফিলিস্তিনি রাজধানী স্থাপিত হওয়ার কথা, সেখানেও ভূমি অদলবদলের কথা বলছেন ওবামা। তিনি ইহুদিবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে যতটা সোচ্চার, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে ততটা উৎসাহ আর দেখাচ্ছেন না। তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন ফিলিস্তিনসহ আরব, পারস্য ও তুরস্কের অনারব নেতারা। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় জয়লাভের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছেন ওবামা। তিনি মনে করেন, ২০১২ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ইহুদি লবি ও জনগণের সমর্থন এবং তাদের অর্থ সহযোগিতা তাঁর খুবই প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল রাজনৈতিক অংশের বিরাট অভিযোগ রয়েছে যে মার্কিন কংগ্রেসের সিনেটর ও রিপ্রেজেনটেটিভদের বেশির ভাগই ইহুদি লবির অর্থে নির্বাচিত। যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বার্থ সম্পর্কে নূ্যনতম অবহেলা কিংবা উদাসীনতা দেখালে তাঁদের রাজনীতি সেখানেই শেষ। তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। প্রেসিডেন্ট ওবামার ব্যাপারেও এ আশঙ্কা এখন পুরোপুরি কাজ করছে। আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ওবামার জয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকে তাঁকে 'এক টার্মের প্রেসিডেন্ট' বলে মনে করেন। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের পক্ষে ন্যায়সংগত কথা বলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ইহুদিবাদীরা তাঁকে বিভিন্নভাবে মুসলিম প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন; কারণ তাঁর বাবা ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এখন ইহুদিদের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নেওয়ার কারণে ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেম, রামাল্লাহ, নাবলুস, গাজাসহ আরব বিশ্বে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এতে একজন সুশিক্ষিত ও বাগ্মী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার রাজনৈতিক এবং বিশেষ করে চারিত্রিক দুর্বলতাই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে, যা এখন অস্বীকার করার উপায় নেই।
ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানকল্পে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামা প্রথম প্রথম যত কথাই বলুন, শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী মোর্চার সরকারকে ফলপ্রসূভাবে কোনো আলোচনায়ই বসাতে পারেননি তিনি। তদুপরি সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তারা ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে বেআইনি বসতি নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে রাজি হয়নি।
ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানকল্পে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভের জন্য ভোট চাইতে গেলে স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৬তম বার্ষিক অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে সে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে গভীরভাবে মর্মাহত হলেও দমে যাননি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি নেতারা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে ভাষণদানের প্রাক্কালে তিনি ফিলিস্তিনের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্য একটি দরখাস্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মহাসচিব বান কি মুনের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে সাধারণ পরিষদে ভাষণ দানকালে প্রেসিডেন্ট আব্বাস বলেছেন, 'ফিলিস্তিনে অবৈধ দখলদারি ও বসতি নির্মাণের অবসান না ঘটলে ইসরায়েলের সঙ্গে বর্তমান সমস্যা সমাধান নিয়ে কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হতে পারে না। বিশ্ববাসীই আজ ফিলিস্তিন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তারা ফিলিস্তিনবাসীর ন্যায়সংগত সংগ্রামের সমর্থন করে। সে কারণেই জাতিসংঘের ১২৩টি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণাকে ইতিমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে এবার বিশ্ববাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণ শোনার জন্য। তার কারণ বহুবিধ। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, অন্যদিকে গণমাধ্যমের ভাষায় 'আরব বিশ্বে বসন্ত' অর্থাৎ পরিবর্তনের হাওয়া, বিশ্ববাসীকে এক অভূতপূর্ব আশা-নিরাশার দোলাচলে আবর্তন করছিল। তার ওপর আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এবং খাদ্যসংকট বিশ্ববাসীকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। সে অবস্থায় এসেছিল এবারের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন। তাকে কেন্দ্র করে নিউ ইয়র্কে সমাবেশ ঘটেছিল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের। তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার সাম্প্রতিক বিদ্রোহ এবং সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইনের জনগণের বর্তমান আন্দোলন বিশ্ববাসীর কাছে যখন একনায়কতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার লাভের দিকনির্দেশনা হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের 'দ্বিমুখী ভূমিকা' (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) ক্ষেত্রবিশেষে চরম ক্ষোভ ও হতাশার উদ্রেক করেছিল। সে অবস্থায় বিশ্বসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'অবিচ্ছেদ্য ও অপরিবর্তনশীল সম্পর্কে'র কথা এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব কোনো পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে না বলে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্য তাঁর সুবিধাবাদী চরিত্র ও ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ লাভের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগে ভীত নন মাহমুদ আব্বাস। কারণ সাধারণ পরিষদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃত মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম, যা তাকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। এসব কারণে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চায় না ফিলিস্তিন এখনই জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ ও সদস্যরাষ্ট্রের পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করুক। তারা চায়, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করার আগে ফিলিস্তিন বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হোক। তাহলে ভূমি অদলবদল, শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা কিংবা ক্ষতিপূরণ দান এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ভবিষ্যতে কোনো ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে না ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। সে কারণেই ইসরায়েলের ইহুদিবাদী নেতারা ও যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবি এবং প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ইহুদিদের দোসররা ফিলিস্তিনের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এতটা বিচলিত ও তৎপর হয়ে উঠেছে।
লেখক : 'প্যালেস্টাইন : এক সংগ্রামের ইতিহাস' গ্রন্থের প্রণেতা এবং বাংলদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.