দূরের দূরবীনে-অসাম্প্রদায়িক শারদ উৎসবের খসড়া by অজয় দাশগুপ্ত

শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালির এক সর্বজনীন উৎসব। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা সম্প্রদায়গত উৎসবের সীমানা ছাড়িয়ে তা বহু আগেই ব্যাপ্তিতে বিশালতা অর্জন করে নিয়েছে। সংস্কৃতি ও জীবনবোধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাঙালিত্ব। একটা সহজ উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শাস্ত্রমতে দুর্গা হিমালয় দুহিতা, কৈলাসে জন্ম তাঁর। ফলে তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, অঙ্গভূষণ, অবয়ব ও আচরণে সে অঞ্চলের প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।


নেই বলব না, তবে থাকলেও বঙ্গদেশের দুর্গার আকার বা প্রকৃতি আজ অন্য ধরনের। ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে পূজামণ্ডপ বা প্রতিমা দর্শনে যে দুর্গা চোখে পড়বে, তিনি কোথাও আমাদের জননী, কোথাও বঙ্গরমণী, কোথাও বা জন্মভূমির মতো সহজ আর পরিচিতা। আমাদের পটুয়া, মৃৎশিল্পী, কারিগর তো আর নেপালবাসী নয়, তার হৃদয়ে বলিউড নায়িকা বা নগ্ন নাভির মূর্তিও খেলা করে না। ফলে আমাদের দুর্গা আমাদের মতোই। তা যদি না হয়, শক্তি ও সাহসের জায়গাটাও কি মজবুত বা উৎস হয়ে উঠতে পারে? বাঙালির দুর্গা তাই হিন্দু-মুসলমান বা অন্য যেকোনো ধর্মের বাংলাদেশির অতিপরিচিত এক অসাধারণ মুখশ্রী।
আরো একটি ব্যাপার এখানে সক্রিয়, যে বিষয় বা যা সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ হয়, তার অন্তর্গত শক্তি বাড়তেই থাকে। একসময় তা হয় প্রেরণা। বাঙালির জীবনে ঈদ উৎসব আজ সে ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছে বলেই তার সর্বজনীনতা বাড়ছে। ঈদের ধর্মীয় দিকটি মুসলমানদের, পালনীয় কর্তব্য-দায়িত্বে এ উৎসব তাঁদের হলেও শিল্প সাহিত্য যে আজ সবার। কোন ঈদ সংখ্যায় কোন লেখক ক্লিক করবেন বা কোন নাটক বা অনুষ্ঠান হিট করবে আমরা কি তা জানি? দেখা যাবে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা বা বিপ্রদাস বড়ুয়ার রচনাই পাঠকনন্দিত হয়ে উঠেছে। হয়ে গেছে সর্বাধিক জনপ্রিয়। পূজা সংখ্যায় সবচেয়ে অধিক প্রিয় ও নন্দিত হয়েছেন বা হবেন হুমায়ূন আহমেদ। এটা কোনো অনুমান নয়। এই বাস্তবতা যেকোনো উৎসবকে তার ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে এনে দাঁড় করায় বৃহৎ এক পরিধিতে। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ধর্মবর্ণ, জাত বা সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ঊধর্ে্ব অন্য এক বিশাল জগতের চাবিকাঠি। যে জাতি বা সম্প্রদায় তা করতে পারে, তাঁদের জীবনে ক্ষুদ্রতা, নীচুতা, সাম্প্রদায়িকতাও তত কম। আমাদের দেশটি যেমন অদ্ভুত বৈপরীত্যের, জাতিও তাই, একদিকে সাংস্কৃতিক বিশালতা, উদার অংশগ্রহণ সর্বজনীন প্রেক্ষাপট দেখতে পেলেও অন্য প্রান্তে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
অসাম্প্রদায়িকতা একটি জীবনবোধ। তার জন্য চাই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, জীবন্ত উদাহরণ, আমাদের রাজনীতিতে কি তা আছে? আমাদের রাজনীতিবিদদের পোশাক, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ম্যানিফেস্টো বা কর্মকাণ্ডে কোনো না কোনোভাবে সাম্প্রদায়িকতার ছাপ দেখতে পাই। মুখে তাঁরা বললেও ভোটের আগে জনরোষের কল্পিত জুজুর ভয়ে ভোট পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতায় কারো মাথায় টুপি, কারো উঠে আসে অন্য কোনো পোশাকের আবরণ। বিশ্বাস থেকে কেউ তা করলে বা করে এলে আমরা তাকে শ্রদ্ধা জানাই এবং তা গ্রামবাংলা ও শহরে হামেশাই চলে আসছে। বরং ধার্মিক নামে পরিচিত মানুষরা অন্তত মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভয়েও কোনো অনিষ্ট করেন না। কিন্তু হঠাৎ পোশাক বদল আর উসকে দেওয়া রাজনীতি মূলত ধর্মের নামে ভোট আর ভোটের নামে সাম্প্রদায়িকতাকেই লালন করে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নামে পরিচিত নিরীহ হিন্দু বা অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন তার শিকার। যে কারণে দেশে গণতন্ত্রের ধারা প্রবহমান। মিডিয়ার প্রাবল্য, ফেইসবুক, টুইটার, কম্পিউটার, মোবাইলে রমরমা হওয়ার পরও সাম্প্রদায়িকতা দমে না।
বিষয় হলো, আবার শারদ উৎসব আগত। বাংলাদেশের প্রকৃতিই বলে দেয় মা তথা জননীর আগমন ঘটছে। মানুষের সাজসজ্জা, পোশাক ও বিশ্বাসের মতো চিরন্তন বিষয়গুলো নিয়ে আর কত দাঙ্গা-ফ্যাসাদ? আর কতকাল প্রাগৈতিহাসিক ধর্মান্ধতা? এ প্রশ্নের উত্তর না মিললে অগ্রগতি আর গণতন্ত্রের ফাঁপানো বেলুন যত ওপরেই উঠুক না কেন, তার আয়ু ক্ষণকালের। বাংলাদেশ ও তার সর্বজনীন চরিত্রের স্বার্থে এর বিহিত জরুরি। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের মতো চতুরতাকে বিশ্বাস নেই। আমাদের আস্থা তারুণ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মে। তারা যদি উপমহাদেশে লালিত দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মের রাজনীতির বাইরে পা ফেলে আধুনিক পৃথিবীর মতো সভ্য হয়ে উঠতে চায়, সবাই মিলেমিশে জীবনযাপনে আগ্রহী হয়, তাহলেই মঙ্গল।
শারদ উৎসব সবার জীবনে মঙ্গল ও শান্তি বয়ে আনুক।

লেখক : সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.