কম্বল গ্রাম কেশুরবাড়ী by আমিনুল হক,

শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের কম্বল গ্রাম কেশুরবাড়ী। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কম্বল গ্রাম বলে পরিচিত কেশুরবাড়ীর তাঁতিরা শীতের জন্য এখন কম্বল ও চাদর তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সব ক'টি তাঁতই এখন খুটখাট শব্দে মুখর। তবে সুতার দ্বিগুণ দাম ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় তারা বেকায়দায় পড়েছেন। সুতার দাম না কমালে আর আর্থিক সহযোগিতা না পেলে এ পেশা ধরে রাখাই মুশকিল বলে
জানান তাঁতিরা। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় সড়কের ভুলি্লরহাট এলাকা থেকে আরও ভেতরে প্রায় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে কিসামত কেশুরবাড়ী গ্রাম। সেখানকার প্রায় সব মানুষই অভাবী। প্রতি বছর শীত মৌসুমেই কেবল তাদের একটা আয়ের পথ হয়, আর তা হচ্ছে কম্বল বানিয়ে খুব স্বল্প লাভে বিক্রি করা। সেজন্যই ওই গ্রামের নাম হয়েছে কম্বল গ্রাম।

সুবোধ দেবনাথ নামে এক তাঁতি জানান, আগে সেখান থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার পিস কম্বল বিক্রি হতো। গত কয়েক বছর থেকে বিক্রি কম হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি অনেক সংস্থা এখান থেকে ট্রাক নিয়ে কম্বল ও চাদর কিনতে আসত। দু'বছর ধরে বড় ক্রেতা আসেনি। তারা জানান, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও কম্বল বিক্রির বাজার না থাকায় তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না। কেশুরবাড়ী গ্রামের নির্বাণ চন্দ্র ও অনিল দেবনাথ জানান, বাপ-দাদার পেশা একবারে ছেড়ে না দিয়ে কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছি। তারা রংপুর, বগুড়া ও সৈয়দপুর থেকে সুতা এনে কম্বল, চাদর, পাপস, ম্যাট ইত্যাদি তৈরি করছেন। সুতা কেনেন মণ দরে। এক মণ উন্নত মানের সুতার দাম পড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এদিয়ে কম্বল তৈরি হয় ২৪/২৫টি। অর্থের অভাবে তারা এখনও মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছেন। গোবর্ধন দেবনাথ নিজের তৈরি কম্বল ফেরি করে বিক্রি করেন। দাম কম হলেও ওই কম্বল শীত নিবারণে বেশ উপযোগী। তিনি বলেন, এ কারণে কেউ কেউ দুস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য আমাদের কাছ থেকে কম্বল কেনেন। সে সব ক্রেতাও এখন খুব একটা আসেন না। সাধারণত তাদের ওপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কেশুরবাড়ী গ্রামে এখন প্রায় ৫০০ পরিবার তাঁতে কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করছে। আগে প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার ওই শিল্পে জড়িত ছিল। তাছাড়া শহরের উপকণ্ঠে বাঁশহাটি এলাকায় কিছু তাঁতি, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার জাউনিয়া গ্রামের ২০ পরিবার, হরিণমারী হাটখোলা গ্রামের ৯০ পরিবার, বাদামবাড়ী ভরনিয়া গ্রামের ২৫ পরিবার এখনও এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছে। ১৯৪৭ সালের আগে তাঁতি পরিবার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ জেলায় এসে বসতি স্থাপন করে। সে সময় তারা ভারতের কিষানগঞ্জ, কলকাতা ও ইসলামপুর থেকে কাঁচামাল এনে কাপড় বুনতেন। স্থানীয়ভাবে তুলা কিনে সুতা কাটতেন। পরে তারা চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করেন। কয়েক বছর আগেও তারা দিনাজপুর বিসিক শিল্পনগরীর অফিস থেকে তুলা, সুতা ও অন্যান্য কাঁচামাল সংগ্রহ করতেন। বর্তমানে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে তুলা উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ফলে স্থানীয় তাঁতিদের বাইরে থেকে সুতা কিনতে হয়। কেশুরবাড়ী গ্রামের তাঁতিরা জানান, সহযোগিতা পেলে তারা উন্নত মানের কাপড় তৈরি করতে সক্ষম হতেন। বর্তমানে তারা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত লোকজনের কাপড়ের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
কম্বলের পাশাপাশি তারা অন্যান্য পোশাকের মধ্যে গায়ের ও বিছানার চাদর, মাফলার, লুঙ্গি, গামছা, জায়নামাজ ও তোয়ালে তৈরি করে থাকেন। তবে কম্বল ছাড়া ওই গ্রামের তৈরি কাপড়ের কোনো চাহিদা নেই। সেখানকার কাপড় বলতে মানুষ কম্বলই বোঝে। তাই শীতকাল ছাড়া সেখানকার কাপড় বিক্রি হয় না। সেখানকার কম্বল দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে দারুণ সমাদৃত। এসব কম্বল একেকটি গড়ে বিক্রি হয় ১৫০ টাকা করে। এতে তাদের লাভ থাকে সর্বোচ্চ ২৫-৩০ টাকা। তাদের বড় সমস্যা সেসব বাজারজাতকরণে। কম্বল বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাজার নেই। তারা সাইকেলে কম্বল বেঁধে ফেরি করে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম এবং হাটে হাটে বিক্রি করে বেড়ান। গ্রামবাসী জানান, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এ এলাকায় তাঁতশিল্পের আরও উন্নয়ন করা সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.