শান্তিচুক্তির ১৪ বছর-পক্ষে শোভাযাত্রা সমাবেশ, বিপক্ষে কালো পতাকা-খাগড়াছড়িতে সড়ক অবরোধ আজ

পার্বত্য চুক্তির ১৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার পার্বত্য জেলাগুলোতে আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচির। চুক্তির পক্ষে যেমন শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সমাবেশ হয়েছে, তেমনি বিপক্ষে ছিল কালো পতাকা উত্তোলনসহ নানা কর্মসূচি। চুক্তি সমর্থনকারীরা অবিলম্বে তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধিতাকারীরা চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছে।


খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে গতকালের সমাবেশে প্রশাসনের বাধা ও সেমুতাং গ্যাস পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পাচারের প্রতিবাদে আজ শনিবার জেলার উপজেলায় আজ অর্ধদিবস সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ।
খাগড়াছড়িতে সকাল সাড়ে ৯টায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের করে আওয়ামী লীগ। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শাপলা চত্বরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকার পাহাড়ে স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে খুবই আন্তরিক। পার্বত্য শান্তিচুক্তি শুধু পাহাড়েই শান্তি প্রতিষ্ঠা করেনি, সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশ্বজনীন মর্যাদা। সমাবেশে বক্তব্য দেন শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলম, কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) উদ্যোগে খাগড়াপুর কমিউনিটি সেন্টারে সমাবেশ হয়েছে। এতে বক্তারা বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অতিবিলম্বের কারণে পাহাড়ে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে। তাঁরা অবিলম্বে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে ভূমি জটিলতা নিরসনসহ পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানান। সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান সুধাসিন্ধু খীসার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন কো-চেয়ারম্যান রূপায়ণ দেওয়ান, কেন্দ্রীয় সদস্য-সচিব তাতীন্দ্র লাল চাকমা ওরফে মেজর পেলে, কাকলি খীসা, সুদীর্ঘ চাকমা প্রমুখ।
এদিকে পার্বত্য চুক্তিবিরোধী বাঙালিদের একাংশের সংগঠন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ কালো পতাকা উত্তোলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে বলে জানিয়েছে। সংগঠনের এক বিবৃতিতে সকালে উত্তোলিত কালো পতাকা ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সরিয়ে ফেলেছে বলে দাবি করে।
খাগড়াছড়ির চার উপজেলায় আজ অর্ধদিবস অবরোধ : চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) একই সময় সমাবেশ আহ্বান করায় খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা সদরের একাংশে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি ছিল। এ কারণে ১৪৪ ধারা বহাল থাকা এলাকার বাইরে মহামুনিতে জনসংহতি সমিতি এবং গচ্ছ্যাবিল ধর্মঘর এলাকায় ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) সমাবেশ করেছে। পিসিপি এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, সেমুতাং গ্যাস বাইরে পাচারের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতা-কর্মীদের পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় বাধা দেয়। সমাবেশে প্রশাসনের বাধা ও সেমুতাং গ্যাস পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পাচারের প্রতিবাদে আজ শনিবার মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি, মাটিরাঙা ও রামগড়_এ চার উপজেলায় অর্ধদিবস সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে পিসিপি।
রাঙামাটিতে গণবিক্ষোভ, সমাবেশ : রাঙামাটিতে সকালে জিমনেসিয়াম মাঠে গণবিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সমাবেশে বক্তারা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। সমিতির জেলা কমিটির সভাপতি গুণেন্দু বিকাশ চাকমার সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক হোসাইন কবির, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য রণজিত কুমার দে, এম এন লারমা ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক বিজয় কেতন চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চলের আহ্বায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সহসভাপতি জয়তী চাকমা ইনু, পিসিপির সহসভাপতি জ্যোতিস্মান চাকমা, জনসংহতি সমিতির জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক কিশোর কুমার চাকমা।
একই সময় দলীয় কার্যালয় চত্বরে আলোচনা সভার আয়োজন করে জেলা আওয়ামী লীগ। এতে বক্তারা বলেন, বর্তমানে বিশেষ একটি মহল চুক্তি বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকারের চুক্তি বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে বিলম্বিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ এমরান রোকন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা স্মৃতি বিকাশ ত্রিপুরা প্রমুখ।
এ ছাড়া পার্বত্য চুক্তি সংশোধনের দাবিতে সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন। রাঙামাটি পৌরসভা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন জাহাঙ্গীর কামাল, আবছারউদ্দিন, আবদুর রশীদ, মোস্তাক আহম্মেদ চৌধুরী প্রমুখ।
বান্দরবানে সমাবেশের পাশাপাশি ছিল কালো পতাকা : বান্দরবানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, আওয়ামী লীগ এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের পৃথক কর্মসূচি ছিল। তবে বাঙালি সম-অধিকার আন্দোলন এবং পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ কোনো সমাবেশ আয়োজন না করলেও শান্তিচুক্তি বাতিলের দাবিতে বান্দরবান শহরে কালো পতাকা উত্তোলন করেছে।
জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা এবং রাজার মাঠে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, সাংবাদিক সালিম সামাদ, জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা কে এস মং ও সাধুরাম ত্রিপুরা এতে বক্তব্য দেন। সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, সরকার শাস্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। উল্টো শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য ইউপিডিএফ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।
বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগ সকালে শহরে শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করেছে। স্থানীয় প্রেসক্লাব চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মজিবুর রহমান বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে 'শান্তিচুক্তি : বাস্তবতা ও বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ' শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে। সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
রাজশাহীতে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন : পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধন করেছে আদিবাসী ছাত্র পরিষদ। সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন আদিবাসী ছাত্র ইউনিয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি উপেন রবিদাস। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী ছাত্র ইউনিয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাস চন্দ্র হেমব্রম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মিঠুন টপ্য, রাজশাহী কলেজ শাখার সভাপতি বলরাম বর্মণ প্রমুখ।
মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে আদিবাসীদের পক্ষে বক্তব্য দেন সাংবাদিক আকবারুল হাসান মিল্লাত, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান, জাতীয় মহিলা পরিষদের রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কল্পনা রায়, পিসিপির রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক, মহানগর সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা পার্বত্য এলাকায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য আদালতের পরিবর্তে আদিবাসীদের প্রথাগত বিচারব্যবস্থা চালু এবং সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার দাবি জানান। এ ছাড়া আদিবাসীদের 'আদিবাসী' হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করাসহ সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশ কোটা পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবি জানান তাঁরা।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি প্রতিনিধি]

No comments

Powered by Blogger.