ইসির সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত হচ্ছে কথা রাখেনি আওয়ামী লীগ by কাজী হাফিজ

জ আমরা কিছু বলতে আসিনি, শুনতে এসেছি। যেসব কথা আপনারা বললেন, তা আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিকে, আমাদের সভাপতিকে জানানো হবে। আমাদের সম্মিলিত মতামত আমরা পরে দেব। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের টেকনিক্যাল কমিটিগুলো আপনাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করবে।'ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল প্রায় চার মাস আগে। কিন্তু তা রক্ষা হয়নি।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওই বৈঠকের সম্ভাবনার কথা জানালেও বাস্তবতা এর অনুকূল নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত ১ ডিসেম্বর থাইল্যান্ড ভ্রমণের জন্য সস্ত্রীক ঢাকা ছেড়েছেন। ফিরবেন ১০ ডিসেম্বর। তার আগেই প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতামত ছাড়াই ইসির সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আর কোনো দলের মতামত পাওয়া যাক বা না যাক, ডিসেম্বরেই সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে।
একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, সরকার এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিলেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগের একটি দলিল হিসেবে এ প্রস্তাব সংরক্ষণ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বাংলাদেশে নির্বাচনী আইনের বড় ধরনের সংস্কার হয়। সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ সব দলই বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যোগ দিয়ে তাদের মতামত জানায়। কিন্তু এবার বড় দুটি দলের মতামত ছাড়া ইসির সংস্কার প্রস্তাবের সফলতা নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'গত ৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যোগ দিলেও কোনো মতামত দেয়নি। সেদিন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ বিষয়ে পরে তারা আমাদের সঙ্গে বসবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে দলটির কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। আমাদের হাতে সময় নেই। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের মতামত ছাড়াই সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে হচ্ছে।'
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ গত ২১ নভেম্বর বলেন, 'ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ইসির সঙ্গে তাদের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বসতে যাচ্ছি।' কিন্তু এ ধরনের বক্তব্যে আস্থা রাখতে রাজি নন নির্বাচন কমিশনাররা। তাঁরা বলছেন, 'ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাঁরা আমাদের সঙ্গে বসতে চাইছেন, তা চিঠি দিয়ে না হলেও সিইসিকে অন্তত টেলিফোনে জানাতে পারতেন। তা যখন তাঁরা করেননি, তখন তাঁদের অপেক্ষায় আমাদের কাজ ফেলে রাখতে পারি না।'
এদিকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত ৩৮টি দলকে সংলাপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেও বিএনপিসহ মোট আটটি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। অন্য দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস ও ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন।
ইসির প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল গত ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে এ সংলাপ শেষ করে দ্রুত দলগুলোর মতামতসহ আলোচ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রস্তাবনাগুলো সরকারের কাছে পেশ করা। কিন্তু মূলত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুবার তারিখ পরিবর্তন করাতেই সংলাপের সময়সীমা ৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
কিন্তু ৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ কোনো মতামত ছাড়াই সংলাপ শেষ করাতে নির্বাচন কমিশন হতাশ হয়। সংলাপ শেষে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের তো আর সময় নেই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নতুন জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়েছে। ওই জনবল কাঠামো অনুযায়ী কমিশন সচিবালয়কে ঢেলে সাজাতে হবে। সব জেলা-উপজেলায় সার্ভার স্টেশন নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের মতামত কবে পাব আর কবে এ সংলাপের সারসংক্ষেপ তৈরি করব?'
সংলাপে সিইসি ও অন্যান্য কমিশনারও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানান, তাঁদের হাতে আর বেশি সময় নেই। আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁরা আছেন। এর পরই তাঁদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিইসি বলেন, 'ইসিতে যাঁরা নতুন আসবেন তাঁদের সুবিধার জন্য আমরা কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে চাই। আমরা কিছু প্রস্তাব দেব। সরকার যদি চায় তাহলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। তবে যা কিছু করার ডিসেম্বরের মধ্যেই করতে হবে।'
এর জবাবে সেদিন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, 'প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে আজকের মতো এত বড় টিম হয়তো আসবে না। কিন্তু আমাদের প্রতিনিধিদল আবারও আসবে।'
নির্বাচন কমিশনের আলোচিত প্রস্তাবগুলো : নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ৩০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করছে তাতে বিদ্যমান আইনের কিছু করণিক ত্রুটি সংশোধনসহ কয়েকটি বিষয়ে নতুন বিধান প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় সশস্ত্র বাহিনীকে আবার অন্তর্ভুক্তি, হলফনামায় কেউ ভুল তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে তাঁকে নির্বাচনে প্রার্থিতার এবং সংসদ সদস্য থাকার অযোগ্য ঘোষণার বিধান করা, একটির বেশি আসনে নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধের পক্ষে বিধান করা, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী যেকোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য নির্বাচনী বিশেষ বিধান-১৯৯১-এর অধীনে সাসপেন্ড করার ক্ষমতা দেওয়া, প্রার্থী আদালত বা ট্রাইব্যুনাল থেকে ফেরারি ঘোষিত হলে তাঁর প্রার্থিতা বাতিলের পক্ষে বিধান করা, নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ১৫ লাখের পরিবর্তে ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা, প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর আয়-ব্যয়ের রিটার্ন গেজেট আকারে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা, পোলিং এজেন্টদের বিষয়ে কিছু বিধান ও প্রচলিত ব্যালটের পাশাপাশি ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট দেওয়ার পক্ষে বিধান করা, দলীয় প্রধানদের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় ভ্রমণের খরচ দলের নির্বাচনী খরচের ভেতর অন্তর্ভুক্ত না রাখা এবং নির্বাচনী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে বিভিন্ন নির্বাচনী অপরাধের বিচার করার জন্য দণ্ড সর্বোচ্চ সাত থেকে দুই বছরে কমিয়ে আনা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নেরও একটি প্রস্তাব রয়েছে ইসির। প্রস্তাবিত ওই আইনে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও একজন নারীসহ দুজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যোগ্যতার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। 'প্রমাণিত প্রশাসনিক দক্ষতা' হবে এ পদের অন্যতম যোগ্যতা। এ নিয়োগে প্যানেল তৈরির জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কমিটির সদস্য ও আহ্বায়ক থাকবেন। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারক, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং মহা-হিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এ কমিটির সদস্য হবেন। কমিটি প্রতিটি পদের জন্য তিনজনের নাম নির্ধারণ করবেন। কমিটির কাজ পরিচালনার নিয়মাবলিও ওই কমিটি তৈরি করবে। প্যানেল প্রস্তুতের পর তা জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির পরীক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পাঠাতে হবে। কার্য উপদেষ্টা কমিটি ওই প্যানেল পরীক্ষা করে চূড়ান্ত করবে।
ইসির প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে, সাধারণভাবে সৎ বলে বিবেচিত না হলে বৈধ আয়ের ভিত্তিতে জীবন নির্বাহ না করলে, জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে এবং ঋণখেলাপি হলে কোনো ব্যক্তিকে ওই প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
ওই প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতি যেকোনো ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুস্পষ্ট আইন থাকার কথা, যার আলোকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন। অথচ আজ পর্যন্ত সেই আইন প্রণয়নের কাজটি অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে।
কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এ প্রস্তাব গ্রহণ না করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সর্বোচ্চ পাঁচজন কমিশনার নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনীতে একটির বেশি আসনে নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধের প্রস্তাবটিও গ্রহণ করা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.