কেমন আছ মা-সন্তানহারা মাকে অর্থকষ্ট স্পর্শ করে না-ফুলজান বেওয়া

বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের মায়েরা কেমন আছেন, তা নিয়েই ধারাবাহিক এই আয়োজন'ইচ্ছা আছাল চাকরি কইরা তোমারে পালমু (ভরণপোষণ করব)। মনে অয় তা আর পারমু না মা। দেশের অবস্থা ভালা না। আমাগো যুদ্ধ করন লাগব। দেশ বাঁচান লাগব।'স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কলিজার টুকরা আবদুস সামাদের এইডাই ছিল আমার লগে শেষ কথা।
আমার সামাদ গেল, আর ফিরা আইলো না। আমি এত বয়সেও ঠিকই বাঁইচা আছি। কিন্তু আমার সামাদ নাই। আমার বেটার (ছেলের) কথা মনে অইলে ঠিক থাকবার পারি না, বেহুঁশ অইয়া যাই।

স্বাধীনতার কত দিন আগে মনে নাই। তয় চাকরি পাওয়ার পর ৯ মাস টেরেনিং (ট্রেনিং) করার পর আর ৯ মাস চাকরি করছে। এর পরই পাকিস্তানিরা আমার সামাদ যেখানে থাকত সেখানকার সবাইরে মাইরা ফালায়। এই খবর আমরা জানবার পারছি স্বাধীনতার পর। পরানের টুকরারে এত দিন পরও ভুলবার পারি নাই।
সামাদ রাগ কইরা বাড়ি থিকা যাইয়া চাকরি নিছিল। এত দিন পরে ম্যালা কথাই মনে নাই। তয় আমার সামাদের কথা মনে আছে। তিন পোলা (ছেলে) ও দুই মেয়ের মধ্যে সামাদ আছিল দ্বিতীয়। বাবার সাংসারিক অবস্থা ভালা আছাল না। অভাব লাইগাই থাকত। জমিজমাও আছাল না। তয় মানুষটা আছাল খুব ভালা। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সামাদ লেখাপড়া করে। বাপের অভাব পোলার ভালা লাগে না। একদিন সামাদ রাগ কইরা বাড়ি থিকা চইলা গেল। যাওয়ার সময় কইছিল, 'আমি পুলিশে চাকরি নিমু। কামাই করমু।'
চাকরি পাওয়ার পর একবার ছুটিতে আইছিল। ২০ দিন বাড়িতে থাকে। আবার চাকরিতে যাওয়ার আগে খাবার বইয়া আর খাবার পারছিল না। কয়, 'আমাগো যুদ্ধ করন লাগব। দেশের অবস্থা ভালা না মা।' এই বইলা আমার বুকে কাঁপন ধরাইয়া সামাদ বাড়ি থিকা গেল। আমার বুকের ধন আর ফিরা পাইলাম না। আমি আইজও বাঁইচা আছি, আর আমার সামাদ নাই!
যেই দিন রাজারবাগে পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি মিলিটারিরা হামলা করে, পরের দিনই আমরা শুনছি। কিন্তু আমার বেটা যে নাই, তা কেউ বলে নাই। যুদ্ধের সময় শুনছি_ওরা অন্য জায়গায় আছে, যুদ্ধ করতাছে। আর্মিরা আমাগো গ্রামেও আক্রমণ করে। আমরা বাড়ি ছাইড়া অন্য জায়গায় থাকছি। একদিন এখানে, অন্যদিন অন্যখানে। আমরা বাঁচার জন্য ঘুইরা বেড়াইলেও মন খালি সামাদরে খুঁজছে। পোলাডা বাঁইচা আছে কি না! থাকলে কবে আবো। অপেক্ষায় থাকছি। যুদ্ধের কয় দিন পর এক পুলিশ আইয়া সামাদের ট্রাংক আর ৩০টা ট্যাহা দিয়া কয়, 'সামাদ আর বাঁইচা নাই।' ট্রাংকে কিছুই আছিল না, খালি। আর ৩০ টাকা নাকি ওই পুলিশ সামাদের কাছ থিকা কর্জ (ধার) নিছিল।
এখন আমার কাছে অন্য পোলার ঘরের নাতি-নাতনিরা থাকে। ওরাও ছোটাছুটি করে, খেলাধুলা করে। কিন্তু আমার বুকের ফাঁপা যায় না। আমার সামাদরে ওগো মইধ্যে খুঁইজা বেড়াই, পাই না।
আদরের পোলাডার জন্য বুকটা সব সময় খাঁখাঁ করে। চোখ দিয়া খালি পানি পড়ে। ভালো কইরা দেখবারও পারি না। চিকিৎসাও করাতে পারি না। ট্যাহা নাই। সামাদরে নিয়া যে ঘরে থাকছি, এহনো সেই ভাঙা ঘরেই থাকি। বড় ছেলে পাশে থাকে। তার নিজের কোনো জমি নাই। অন্যের জমি বর্গা আবাদ করে। দিনমজুরের কামও করে। আরেক ছেলে ৯ বছর ধইরা বাড়িছাড়া। অন্যের কাছ থিকা ট্যাহা কর্জ নিয়া ঢাকায় গার্মেন্টে কাম (কাজ) নিছে। সেই ট্যাহা এখনো শোধ করবার পারে নাই। তাই বাড়িও আইবার পারে না। বউ-পোলাপান নিয়া সেখানেই থাকে। আমি যে ঘরে থাকি_পাটশোলার বেড়া, ওপরে পুরান টিন। বিষ্টির দিনে পানি পড়ে। সারা জীবন খুব কষ্ট পাইয়া চার বছর আগে সামাদের বাপ চইলা (মারা) গেছে। মানুষটা কোনো দিন আরাম-আয়েশ আর ট্যাহার মুখ দেইখা যাইতে পারল না। তয় এইডাও ঠিক, যার তরতাজা পোলাডা মইরা গেছে, তাঁর আর অন্য কী কষ্ট থাকব। আমারেও আর অন্য কোনো কষ্ট ছুঁইতে পারে না।
শেখ সাহেব (শেখ মুজিবুর রহমান) থাকতে একবার দুই হাজার ট্যাহা দিছাল। তারপর আর ট্যাহা-পয়সা কেউ দেয় নাই। এবার (চলতি বছর) জুন মাসে মন্ত্রী ডাইকা নিছাল। পুলিশ পদক দিছে (বাংলাদেশ পুলিশের স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১১ অর্জন উপলক্ষে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল আবদুস সামাদকে দেশপ্রেমের স্বীকৃতি স্মারক দেওয়া হয়েছে)। মাঝেমধ্যে সরকার থিকা চিঠি আহে। আমি চিঠি পড়বার পারি না। চিঠি পাইলেই মনে অয়, আমার সামাদের খবর আইছে। আমাগো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়। কী অবো এসব দিয়া। কিছু ভালা লাগে না। আমি অস্থির অইয়া যাই। আমি পোলার শোকে পাগল। আমার বেটা তো আর ফিরা আইব না।
ফুলজান বেওয়া
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুস সামাদের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার লোকেরপাড়া ইউনিয়নের পাঁচটিকরি গ্রামে। এই বীর শহীদের জন্মদাত্রী ফুলজান বেওয়া আজ ৮৫ বছরের বৃদ্ধা। ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরোচিত আক্রমণে অন্য অনেকের সঙ্গে শহীদ হন আবদুস সামাদ। ফুলজান বেওয়া আদরের সন্তানের জন্য আজও চোখের পানি ফেলেন। অভাব-অনটনের জীবনে সরকারি-বেসরকারিভাবে তেমন পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। কিন্তু না পাওয়ার কষ্ট এই গর্বিত মাকে তেমনভাবে স্পর্শ করে না। তাঁর অভিব্যক্তি_সন্তান হারানোর কষ্টের কাছে আর কোনো কষ্টই আমল পায় না।
অনুলিখন : অরণ্য ইমতিয়াজ (টাঙ্গাইল প্রতিনিধি)

No comments

Powered by Blogger.