সহজ-সরল-সব মানুষ এক কাতারে দাঁড়ালে দোষ কী by কনকচাঁপা

মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করে তার বংশ, পদবি, শিক্ষা, চাকরির বেতন ও সৌন্দর্য দিয়ে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি একজন মানুষকে তার কাজের পরিধি, প্রয়োজনীয়তা দিয়ে বেশি মূল্যায়ন করি। একটা দেশে রাজাই প্রধান, আমার কাছে কিন্তু কৃষকই প্রধান। কৃষক ফসল উৎপাদন করে বলেই রাজা ফেলে-ছড়িয়ে খেয়ে বাঁচে। আমার এই মূল্যায়ন হয়তো খেপাটে কিসিমের। হোক আমার ভাবনা তো আমিই ভাবি।


আমি ভাবি, জানি ও বিশ্বাস করি একজন গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর চেয়ে পরিচারকের মূল্য অনেক বেশি। সম্মান কিন্তু তাদের আকাশে আর পাতালে। যদিও পরিচারক বা স্পষ্ট ভাষায় 'কাজের মানুষ', 'ছুটা বুয়া' আগের মতো আর সহজলভ্য নয়, তবুও যেমন করেই হোক, সবার বাসায় তাদের উপস্থিতি অতি আবশ্যক। কারণ তাদের ছাড়া আমাদের চলে না। ছোটবেলায় যেমন মা-বাবা, খালা, ফুফু, চাচা, মামাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, এখন এই বেলায় আমি তাদের ওপর তেমন নির্ভরশীল নই। আশা করি, এতে উপরোলি্লখিত আত্মীয়স্বজনরা মনঃক্ষুণ্ন হবেন না, তারা তাদের স্থানেই আছেন। এই ২৭ বছরের সংসারজীবনে চম্পা, শিউলি, জুঁইয়ানা, নাসিমা, রেবা, আনোয়ারা, কোহিনূর, আসমা, কতজনের কাছেই না আমি ঋণী। তাদের আমি পারিশ্রমিক দিয়েছি বটে, কিন্তু তাতে কি তাদের মাহাত্ম্য এতটুকুও কমেছে? দিন যাচ্ছে_আমি তাদের ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। আমার কন্যার বিয়ের সময় রেবা যে কাজ করেছে, তা বোধকরি চারজন মানুষের পক্ষেও করা সম্ভব ছিল না এবং সে সেটা করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। এবং আমার মেয়ের বিয়েতে সে ছিল বিশেষ মেহমান। বিয়ের দিন তার পরিহিত পোশাকাদি আমার এক আত্মীয়ার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আত্মীয়া মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন! এ মুহূর্তে আমাকে যে সচল রেখেছে, সে আসমা। আসমা আসমা ডাকতে ডাকতে বলি 'তোমার মা এমন নাম রেখেছেন_সারাক্ষণ মা মা বলে ডাকতে হয়।' সারাক্ষণ আসমা হারমোনিয়াম, আসমা কলম, আসমা ভাত, আসমা ফ্যান। আরে সব প্রয়োজনীয় দ্রবের নাম আসমা? সবাই বলে এত ব্যস্ত থাকার পর সেলাই, ছবি আঁকা, গাছগাছালি, আচার_এত সব কিভাবে করতে পারেন? আমি হাসি। আমার চাবিকাঠি আসমা। আমি ভুলেই গেছি, আমার এই ঘরে কয়টা বারান্দা, কত কাপড়, কত থালাবাসন মানে মোট কাজ কত! তো এই ঈদের পর আসমা ১১ দিনের জন্য বাড়ি গেল। আমি কুয়ায় পতিত হলাম। ওর যা কাজ তা আমি বাদে আর কেউ পারে না_যদিও আমাদের গৃহকর্তা অনেক সাহায্য করেন। তবুও। আমার খাওয়া-ঘুম-হাসি সব বন্ধ। এই কয়েক দিনে দুই-তিন দফা মেহমান, দুটি চ্যানেলে দুটি সরাসরি গানের অনুষ্ঠান, দুটি স্টেজ প্রোগ্রাম করলাম। এই ১১টা দিন যেন আমার ১১টা মাস গেল! আসমা ফিরে এলে আমি হাসলাম, ওকে ধন্যবাদ জানালাম। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে কী একটু দ্বিধা হলো_নাহ্ ওসব ভণিতা আমার নেই। নেই উঁচু-নিচু ভেদাভেদ। আমার আত্মীয়স্বজন বলে ওদের অত মাথায় তুলো না, তাতে আমাদের অসুবিধা হয়। আমি বেকুব হয়ে যাই। ওরা যে মূল্যবান বা পরিবারের প্রধানতমদের একজন, এ কথা স্বীকার ও প্রকাশ করলে দোষ কোথায়? ক্রীতদাস লালনের দিন কি আছে? ওদের কাছে সাহায্য নেব আর স্বীকার করব না? এটা কি নিজেই নিজেকে ফাঁকি দেওয়া না? আসমা ছিল না বলে আমি আমার এবারের জন্মদিন পালন করতে পারিনি। এটা আমার সরল স্বীকারোক্তি। কারণ একটা উৎসব পালন করতে হলে এক হাতে সেটা সম্ভব নয়। তার মানে এই না যে আমি একজন অলস। ওরা আমার ঘরের নিত্যকরণীয় কাজগুলো সম্পাদন করে বলেই আমি আমার সৃষ্টিশীল কাজগুলো সম্পাদন করতে পারি। আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছেন, যারা যুগে যুগে পরিচারকদের ছ্যাঁকা দেন, বাথরুমে বেঁধে রাখেন, যৌন নিপীড়ন করেন। তাঁরা আসলে মানসিক বৈকল্যে ভোগেন। তাঁদের চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু যারা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, তাদের আহ্বান করি, আসুন, আমরা ওদের আমাদের কাতারে নিয়ে আসি। একজন সুস্থ ও প্রয়োজনীয় মানুষ হিসেবে ওদের খাওয়া, কাপড়, চিকিৎসা, আনন্দ, সব কিছুর জোগান দিই। কারণ ওরা আমাদের 'জীবন' জোগান দেয়! আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মৃত্যুর সময় শেষ কথা বলেছেন, 'তোমরা নামাজ ছেড়ো না এবং দাস-দাসীদের দায়িত্বে অবহেলা কোরো না।' তিনি এত কথা বাদে দাস-দাসীদের কথা কেন বললেন। কারণ আমাদের জীবন যত মূল্যবান, ওরাও তত মূল্যবান। ওরা না থাকলে জীবন বড্ড ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। এ কথাটা নিজেও জানি_ওদেরও জানাই। এতে আমার মূল্য একটুও কমবে না।

লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.